বব ডিলান: ছায়ার জগতে ৮০ বছর

নাকি সুর, স্বরে খসখসে আওয়াজ, যেন কেউ হেঁটে যাচ্ছে এক তেপান্তর দিয়ে পরাণের গহীনের বেদনা ক্ষোভ আওড়াতে আওড়াতে, যেখানে মানুষ আছে, আছে ভিড়, কিন্তু তারচেয়ে বেশি আছে কোনকিছু না থাকা— আমি মুহূর্তের জন্য থামলাম। আমার বয়স তখন ২৯, উত্তর গোলার্ধে লম্বা হিম ঠাণ্ডা রাত আবার কখনও মোলায়েম রোদের লম্বা দিনের ভেতরসময় কাটে লাইব্রেরিতে, এবং কখনও আকণ্ঠ সুরা পান করে নারী দেহের উষ্ণতা থেকে ওম এবং তাদের শীতলে ডুবসাঁতার দিয়ে। আমি থামলাম, রেকর্ডে বাজছে-

“Somebody seen him hangin’ around
At the old dance hall on the outskirts of town
He looked into her eyes when she stopped him to ask
If he wanted to dance he had a face like a mask”

আমি বলছি ১৯৮৯ সেপ্টেম্বরের কথা, ডিলানের নতুন রেকর্ড বেরিয়েছে, Oh Mercy! ডিলানের গান আগে বিক্ষিপ্ত ভাবে শুনেছি, ভাল করেই জানতাম তাঁর গায়ে প্রতিবাদের তকমা; কিন্তু এ ডিলানকে আমি জানতাম না। শুরু হল আমার জীবনের নতুন অধ্যায়, চেতনার উন্মোচন—বব ডিলান আমার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করল, প্রায় একই সময় আরও দুজন বোধের রূপকারের সাথে দেখা, লেওনার্ড কোহেন ও টম ওয়েটস। স্কেন্ডেনেভিয়ায় এবং বলা যায় উত্তর ইউরোপে আশির দশক ও নব্বই’র জনমানস অস্তিত্ববাদের চর্চায় অবচেতনের তল থেকে নুড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। এরকম অন্বেষণের আকৃতিহীন যাত্রায় ডিলান, কোহেন ও টম ওয়েটস ছিলেন নাবিক ও ডুবুরি। ডিলান ছিলেন সেই নাবিক ও ডুবুরিদের অগ্রভাগে।

ডিলান ছয় বছরে তিনবার নরওয়েতে কনসার্ট করেছেন, প্রতিটিতেই আমি গেছি, গেছে অগুনতি ভক্ত। সব বয়সের সমষ্টিতে কাল্ভঅয়া কনসার্ট হয়ে উঠত যেন বাইবেলে প্রতিশ্রুত পুনরুত্থান যেখানে মিলিত সব আদম সন্তান। কাল্ভঅয়া একটি দ্বীপ, অসলো থেকে সামান্য দূরে। দলে দলে লোক আসছে, কেউ যাচ্ছে একা—ঝিম মেরে তাকিয়ে আছে ডিলানের দিকে। পাশেই হয়তো একটি পরিবার, বাবা মা ও তাঁদের শিশু সন্তান এবং ঘরের কুকুরটিও আছে তাঁদের সাথে। হাওয়ায় উড়ে আসছে জলের ছাট—জলের ভেতর মাছেরাও শুনছে ডিলানের গান— “He saw an animal that liked to snort Horns on his head and they weren’t too short”, “How many seas must a white dove sail Before she sleeps in the sand”, “Sweet virgin angel, sweet love of my life Sara” —, হাওয়ায় বুক ভরে টেনে নিঃশ্বাসে ছেড়ে দেয়া সিদ্ধির গন্ধ। এ এক জীবনের মেলা যেখানে মানুষ গেছে নাবিকের সঙ্গ পেতে, যে দৃশ্যমান জগতের ডানায় মানুষকে অদৃশ্য এক অরূপে নিয়ে যায়।

১৯৯৩ এর বসন্তে এরকমই একটি কনসার্টের পর আমরা কয়েকজন মিলিত হয়েছি পাবে। উল্লাসের চাইতে আমাদের ভেতর বিস্তার করে আছে প্রশান্তি। সে আসরেই কেউ একজন বলল, ডিলানকে নোবেল দেয়া হোক। প্রায় একযুগ বা তার চেয়েও বেশি সময় এ দাবিটি জোরদার হয়েছে জনডিসকোর্সে; ফলশ্রুতিতে ২০১৬-তে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় বব ডিলানকে।

প্রতিবাদ-উত্তর ডিলানের পরাবাস্তব শব্দমালায় একটি বিমূর্ত জগত রূপায়িত হয়, যা শুধু অরূপকেই ছায়ায়িত করে মানুষের অভিজ্ঞতা এবং বোধ, জানা ও কল্পনা, এবং আর্তি ও উদাসীনতাকে এক পেয়ালায় এনে। প্রতিবাদের গায়ক হিসেবে ডিলান জনপ্রিয় হলেও চেতনার আস্তরন ছাড়িয়ে আবারও তা অন্য কোন চেতনে নিয়ে যাওয়ার নবি ডিলানই আমার কাছে প্রকৃত ডিলান।

আজ নাবিক ও নবি বব ডিলানের জন্মের ৮০ বছর। এখনও গানে কনসার্টে বব ডিলান ২০ বছরেরই তরুণ যখন আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছি। এখনও নাবিক ছায়ার জগতে কায়ার কথা বলে যার কোন রূপ নেই, নেই কোন ইতি। এতো তাঁরই কথা—

“There are no mistakes in life some people say
It is true sometimes you can see it that way
But people don’t live or die people just float”

 

 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

কনসার্টগানগায়কডিলাননোবেলপুরস্কারবববব ডিলানলিড বিনোদনসংগীতসাহিত্য