বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেকে ‘বলী’ দিয়ে দলের ‘ত্যাগী নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবার এমন এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি যা নজিরবিহীন। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেননি তিনি, দূরে ঠেলেছেন সাংসদ হিসেবে পেতে যাওয়া সমূহ সুবিধাদি। তার এই উদাহরণ দলটির মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির যে ক’জন এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন অন্যতম। ওই নির্বাচনে দল হিসেবে বিএনপির ফল বিপর্যয় হয়েছে। নিজেকে একাধিক আসনে নির্বাচন করে নিজস্ব এলাকা ঠাকুরগাঁও থেকে পরাজিত হলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকা বগুড়া-৬ থেকে নির্বাচিত হন ফখরুল। এরপর নানা আলোচনা আর নাটকের পর বিএনপি দলীয় সকল সাংসদ শপথ নিলেও শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন ফখরুল।
এই শপথ নিয়ে বিএনপির মধ্যে অনেক নাটক হয়েছে। শপথ নেওয়া, না নেওয়া নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি শেষ মুহূর্তে দলীয়ভাবে শপথের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানানো হলেও দলের এই সিদ্ধান্তের বাইরে থেকে যান ফখরুল। তার এই সিদ্ধান্ত, ভূমিকা কিংবা পরিণতি নানা আলোচনার খোরাক যোগালেও শেষ পর্যন্ত দলের বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে ‘বলী’ দেওয়ার এটা এক উদাহরণ। কারণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে তারা মাত্র ৮ আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে পরাজিত বাকি ২৯২ জন প্রার্থীর মতামত কিংবা চাপ ছিল সংসদে যোগ না দেওয়ার। এবং মির্জা ফখরুল ছাড়া বাকি কেবল ৭ জন সংসদে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন। এখানে তার আগ্রহ ছিল কিনা এনিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার সুযোগ ছিল না, কারণ তিনি বিজয়ী-বিজিত উভয়ের নেতা ছিলেন এবং তাদের কাউকে বাদ দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কিংবা নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রকাশের সুযোগ তার জন্যে ছিল সীমিত।
এমন অবস্থায় দলের বাকিরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেও এবং তাদের ওই শপথ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের নামে পরিচালিত হলেও বিজিত ২৯২ জন প্রার্থীর অনুভূতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না মির্জা ফখরুলের। ফলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হলো তার ক্ষেত্রে। ‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ বিএনপির সাংসদরা শপথ নিলেও মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া একইভাবে ‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ বলে জানানো হয়। এতে করে দৃশ্যমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব, কিন্তু প্রকৃত অর্থে লাভবান হয়েছে তার রাজনীতি। একই সঙ্গে মহাসচিব পদে তার আসনও স্থায়ী হয়ে গেছে। ফলে বিএনপির শপথ নেওয়া পাঁচ সাংসদের নেতা হিসেবে যেমন থেকে গেছেন মির্জা ফখরুল, তেমনি ভাবে পরাজিত বিপুল সংখ্যক প্রার্থীরও নেতা হয়ে ওঠেছেন তিনি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গেজেট প্রকাশের পর সাংসদদের শপথের যে নিয়ম সেখানে একটা পর্যায় আছে সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত ৮ জন সাংসদদের মধ্যে প্রথমে শপথ নিয়েছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগ ও বর্তমান (পরে বহিস্কৃত) গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। এরপর শপথ নেন গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান। এ দুইজনের শপথের পর ‘বিএনপির সিদ্ধান্ত অমান্য করে’ প্রথমে শপথ নেন জাহিদুর রহমান জাহিদ। জাহিদের শপথের পর বিএনপি তাকে বহিস্কার করে। এরপর বিএনপি দলীয় হারুনুর রশীদ, আমিনুল ইসলাম, উকিল আবদুস সাত্তার ভুঁইয়া ও মোশাররফ হোসেন এইচারজন সাংসদ শপথ নেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাহিদুর রহমান শপথ নিয়ে বহিস্কার হলেও বিএনপির চারজন সাংসদ শপথ নিয়েছেন ‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’- এমনটাই জানিয়েছে বিএনপি। ফলে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিয়ে জাহিদুরের বহিস্কার, ‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ চার সাংসদের শপথ এবং ‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া- এই এক ইস্যুতে তিন-তিনটা ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। এটা তাদের অস্থির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হলেও এর সুবিধাভোগী আদতে দলটির মহাসচিব।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। নয়াপল্টন কেন্দ্রিক রুহুল কবীর রিজভী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদসহ একপক্ষ ফখরুলবিরোধী বলে শোনা যায়। ওইপক্ষ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট বলেও কানাঘুষা। এরবাইরে মির্জা ফখরুল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াপক্ষের লোক হিসেবেই পরিচিত। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনসমর্থনহীন নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সহযোগী দল হিসেবে বিএনপির যোগদান নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্নের মুখে ছিলেন মির্জা ফখরুল। আর নির্বাচনে বিপুল ভরাডুবির পর দলের একাংশ যখন তূনে তীর দাগাচ্ছিল তার দিকে তখন দলের মধ্যেই নেতৃত্ব বিষয়ক প্রশ্নের মুখে ছিলেন ফখরুল। এমন অবস্থায় একটা বড় ত্যাগের উদাহরণ সৃষ্টির দরকার ছিল তার; আর যখনই সে সুযোগ এসেছে তখনই সেটা লুফে নিয়েছেন তিনি। দল ও জোটের সকল নির্বাচিতরা শপথ নিলেও নিজেকে এরবাইরে রেখে বাকি সকলের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। এতে করে দলের মধ্যকার তার বিরুদ্ধতাবাদীদের মুখ বন্ধ করে রাখতে পেরেছেন তিনি। একই সঙ্গে বিএনপির সর্বেসর্বা নেতা তারেক রহমানের আস্থাভাজন হতে পেরেছেন তিনি। পাশাপাশি নির্বাচনকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেওয়া পরাজিতদের সমব্যথী হয়ে ওঠে তিনি নিজেকে তাদের কাতারে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বগুড়া-৬ আসনের সাংসদ হিসেবে শপথ না নেওয়ায় বিধি অনুযায়ী ওই আসন শূন্য ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন ওখানে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শোনা যাচ্ছে, ওই উপ-নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি।
‘দল ও তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ বিএনপির সাংসদদের শপথ নেওয়ার পর দলটির মহাসচিবের শপথ না নেওয়ায় কারণে শূন্য আসনে উপনির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের যে সিদ্ধান্ত সেটা ইতিবাচক। শপথ না নিয়ে আসন শূন্য করে সেই শূন্য আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বিএনপির অস্থির ও উদ্দেশ্যহীন রাজনীতির একটা প্রমাণ হিসেবে যেমন উল্লেখ করা যায় তেমনিভাবে একে মির্জা ফখরুলের মহাসচিব পদকে পাকাপোক্ত করার একটা উপলক্ষও বলা যায়। সাংসদ পদ, নাকি দলের মহাসচিবের পদ- এ দুই থেকে ফখরুল বেছে নিয়েছেন দলীয় পদকেই। কে জানে, শপথ নিলে হয়ত তাকে হারাতে হতো দলের পদটিকেই; অন্তত বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিপ্রবাহ সে কথাই বলছে। এখন উপনির্বাচনে মির্জা ফখরুল অংশ নেবেন কিনা, আর অংশ নিলেও নির্বাচিত হতে পারবেন কিনা এনিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দলের মহাসচিব পদ নিয়ে অন্তত আর প্রশ্ন থাকছে না। শপথ না নেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি দলে নিজের জায়গাটি স্থায়ী করতে পেরেছেন। তার বিরুদ্ধতাবাদী, অভ্যন্তরীণ দলীয় প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করতে পেরেছেন তিনি যদিও গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও পরাজয়ের একটা দায় তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা অভ্যন্তরীণ প্রবণতা এখনও চলমান।
সাংসদ হিসেবে শপথ না নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য তিনি দলীয় পরাজিত প্রার্থীদের সহমর্মী হতে পেরেছেন। ‘ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ’- এই আপ্তবাক্যের একাংশ পূরণ করেছেন মির্জা ফখরুল। দলের স্বার্থের জন্যে তিনি ব্যক্তি স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু দেশের জন্যে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে পারেননি। মির্জা ফখরুল বিএনপির ত্যাগী নেতা হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন; তবে পারেননি দেশ ও জাতীয় নেতা হতে। এটা তার ব্যর্থতা, এটাই তার রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা!