একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক যখন স্যাটায়ার বুঝতে পারেন না, সেই জাতির আমি আর কোনো ভবিষ্যত দেখি না। আমি মানুষের বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আপনার মতামত যতক্ষণ পযর্ন্ত সরাসরি কোনো মানুষের জন্য শারীরিক বা মানসিক হুমকির কারণ নয়, ততক্ষণ পযর্ন্ত আমি আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। সে মতামত মান্ধাতার আমলের, অন্ধ ও গোড়া হলেও।
আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ প্রবন্ধ নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে একটা স্যাটায়ারধর্মী স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে, যে তিনি শাড়ি না নিয়ে লুঙ্গি নিয়ে লিখতে পারতেন। বলেছি শাড়ি নিয়ে তার কী অভিজ্ঞতা আছে? আসলে বলতে চেয়েছি তিনি শাড়ি পরেন না, ফ্যাশন ডিজাইনারও নন, শাড়ির বিজ্ঞাপনের দায়িত্বেও নেই, এটা ছিল স্রেফ কৌতুক। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য (শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য নন) বুঝলেন না। তিনি তার ‘তোমার হলো শাড়ি আমার হলো সাড়া’ মতামতে দেখলাম আমার স্ট্যাটাসের উল্লেখ করে আমাকে ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ বলেছেন। আমার নাম লেখেননি সে এক স্বস্তি। উনি বিখ্যাত মানুষ, ওনার লেখা অনেকেই পড়বে। আমার বিদ্যা-বুদ্ধির অবস্থা জেনে গেলে বিপদ।
তবে আমার নিজেকে সত্যিই বুদ্ধির ঢেঁকি মনে হয়। কারণ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধের নান্দকিতা আমি ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। তার লেখাটি পড়ে লাইনে লাইনে আমার মনে যত প্রশ্ন জেগেছে তার কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি, ওনাকে সমর্থন করে যারা লিখেছেন তাদের কোনো লেখায়।
প্রথমত, শালীনতার সংজ্ঞা কী? এর মাপকাঠি কী? কারা ঠিক করে দেবে? দেশে দেশে এর কত পাথর্ক্য! পশ্চিমাবিশ্বে বিকিনিকেও মানুষ শালীন পোশাক মনে করে, অন্যদিকে আরব বিশ্বে শাড়ি, সালওয়ার-কামিজকে অশালীন পোশাক মনে করা হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও সেখানে শাড়ির উপর বোরখা পরে তাদের নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করতে হয়। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কোন শালীনতার কথা বলেছেন?
দ্বিতীয়ত, উনি নারীদের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলেছেন, ব্যবহার করা টার্মগুলো ছিল ‘অপরূপ’, ‘কমনীয়’ ‘ললিত-মধুর’। মনে হলো উনি মনে করেন উচ্চতা বা শারীরিক গঠন, সুন্দরের একটা মাপকাঠি। ওনার এই সুন্দরের ধারণার সঙ্গে মান্ধাতার আমলের, প্রাচীন পিথাগোরিয়ান সৌন্দর্যবাদীদের ধারণার মিল পেলাম।
এই ধারণায় মনে করা হয়, আকার, আকৃতি, শৃংখলা, ইত্যাদি দিয়ে সৌন্দর্যকে মাপা যায়। বলাই বাহুল্য মানুষের ক্ষেত্রে এই চিন্তাধারা ভয়াবহ বণর্বাদী এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক। যেমন: আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখায় উঠে এসেছে, লম্বা নারীরা সুন্দর। তিনি নারীর উঁচু-নীচু শারীরিক গঠনের কথাও বলেছেন। ভালো হতো যদি বুকের এবং কোমরের আদর্শ মাপ (ওনার মতে) দিয়ে দিতেন। যারা মনে করেন সুন্দর মানে ফর্সা, চিকন স্বাস্থ্য না হলে আকর্ষণীয় হওয়া যায় না, তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে ওনার চিন্তার পার্থক্য আমি ধরতে পারি নাই। অন্যরা অনেক লিখেছেন, আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। আমি বুদ্ধির ঢেঁকি অবশ্যই, আমার ধারণা ছিল ওনার মতো আলোকিত মানুষ আধুনিক সৌন্দর্যবাদী হবেন যারা মানুষের মধ্যে নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য খোঁজেন।
শিশির ভট্টাচার্য্য, নারীর শরীরের মাপজোক বণর্নায় দোষ খুঁজে পাননি। প্রশ্ন তুলেছেন, সাহিত্যে-শিল্পে নারীর শরীর বণর্নায় অসুবিধে কই? জনাব শিশির, আপনি বুঝতে পারেননি আপত্তির জায়গাটি। শরীরের মাপ বা শরীরের বণর্নায় কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা যখন আপনি কোনো একটি মাপকে উচ্চ (সুপিরিয়র) এবং অন্যটিকে নীচু (ইনফিরিয়র) বলে প্রচার করেন।
এটি বর্ণবাদ বলে মনে হয় কী? শাড়ি প্রবন্ধে পরিস্কারভাবে বাঙালি নারী এবং জাতিকে ছোট করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন, ‘বাঙালি নারীর ঘাটতি উচ্চতা’, ‘বাঙালির শারীরিক গঠন সুগঠিত নয়’। কেন আমাকে লম্বা হতে হবে আমি বুঝি না! লম্বা নই বলে আমি মোহনীয়, ললিত-মধুর নই? ওনার সুগঠনের সংজ্ঞা যে সঠিক, সেটা কে সেট করে দিয়েছে?
তাছাড়া তিনি বাঙালি মেয়েদের হেয় করেছেন। বলেছেন, তারা পশ্চিমা পোশাক পরে হাস্যকর পরিতৃপ্তি পাচ্ছে। পশ্চিমা পোশাক পরে আমাদের তৃপ্তি হলে সেটা কেন হাস্যকর মনে হয় ওনার কাছে? উনি আরও লিখেছেন, ছেলেদের দৈহিক সৌন্দর্য নাকি বড় ব্যাপার নয়! উনি কি মনে করিয়ে দিলেন লিঙ্গবৈষম্যমূলক প্রবাদ, ‘সোনার চামচ বাকাও ভালো’? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে কেউ এই ধরণের স্টেরিওটাইপ চিন্তা আশা করেনি। আপনি করেছেন শিশির?
অবাক হয়েছি যখন আপনি লিখেছেন, ‘সাদেকা হালিম ও কাবেরী গায়েন নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করেন নিজেকে অন্যের পাতে দেয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে’, যদি তাই মনে করেন, তবে আপনি কেমন করে বুঝবেন যে নারী পণ্য হলে কী অসুবিধা আছে? কোনো অসুবিধা নেই, পদিপিসিকে পণ্য বানিয়ে বেঁচে দিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)