আমার মনে হয় গত কয়েক বছরে রাজধানীতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে । যদিও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় যাত্রা, পালাগান, মেলা বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার ভেতরের কথা আলাদা । প্রতিদিনই এই যাদুর শহরে প্রদর্শনী চলছে, গানের আসর বসছে, নাটক হচ্ছে, নাচের উৎসব হচ্ছে । শহরের বিভিন্ন স্থানে খুলছে একের পর এক বিশাল পরিসরের বইয়ের দোকান । সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক। জাতীয় নাট্যশালায় নাটকের পর নাটক চলছে। জাতীয় চিত্রশালার প্রতি তলায় চলছে প্রদর্শনী।
কিছুদিন আগে চিত্রশালায় হয়ে গেলো ‘পোর্টেটস অব লিমা’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী । প্রদর্শনীর ব্যানার ও পোস্টারে রাখা হয়েছিলো এক রূপবতী নারীর সাদাকালো পোর্টেট । কিন্তু যখন জানতে পারলাম ৫ দিনের এই প্রদর্শনীর আয়োজক কনসুলেট অব দ্য রিপাবলিক অব পেরু- তখন বুঝতে বাকি নেই যে লিমা কোনো রূপবতীর নাম নয়, লিমা পেরুর রাজধানী।
ছবিগুলো সম্পর্কে কিছু বলার আগে, ছবিগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে লিমা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ব্যস্ত শহর । বাণিজ্যিক এই বন্দর নগরকে সেসময় ‘দ্য পার্ল অব প্যাসিফিক’ বলা হতো । স্বাভাবিক কারণেই তখন ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ী-পর্যটক-শিল্পীরা দলে দলে ভিড় করতে থাকে এই শহরে।
এমনই এক সময়ে- ১৮৬৩ সালে ফরাসি আলোকচিত্রী ইউজিন কোরেট ও তাঁর ভাই একিলিস লিমায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি ফটো স্টুডিও- ‘ফোটোগ্রাফিয়া সেন্ট্রাল’ । ইউজিন কোরেটের জন্ম ফ্রান্সে ১৮৪১ সালে । ১৮৬০ সালে তিনি লিমায় পাড়ি জমান।
কোরেট ও তাঁর ভাই স্টুডিওতে পেরুভিয়ান সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের ছবি তোলা শুরু করেন। বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিরাও ক্যামেরাবন্দী হতে থাকে। শুধু ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক নয়, সত্তর ও আশির দশকেও তাঁরা ছবি তুলেছেন। বাড়ির কর্তা থেকে শুরু করে ভৃত্য, অভিবাসী থেকে ধর্মযাজক, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত- হাজারো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে সাদাকালো ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অসুস্থতার কারণে ১৮৮৭ সালে কোরেট জন্মভূমি ফ্রান্সে ফিরে যান এবং সেখানে স্টুডিও’র নতুন শাখা খোলেন। পেরুর এবং ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বহু পুরস্কার অর্জন করে স্টুডিওটি। সবচেয়ে বড় সম্মাননাটি আসে ১৯০০ সালে; প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সাল এক্সপোজিশন’-এ ফোটোগ্রাফিয়া সেন্ট্রাল স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়।
১৯৩৫ সালে কোরেট দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায় । ততোদিনে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, বিশ্বমন্দাও চলছিল । শেষদিন পর্যন্ত স্টুডিওটিতে জমা হয় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮০০ গ্লাস নেগেটিভ! কোরেট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন । ঋণের বিপরীতে অনেক পাওনাদারকে কোরেট সেসব নেগেটিভ দিয়ে দিতে বাধ্য হন । পাওনাদারদের মধ্য রেনশিফো পরিবারও ছিল । তাদের হাতে আসে ৫৪ হাজার নেগেটিভ। ১৯৮৭ সালে তারা এই নেগেটিভগুলো পেরুর জাতীয় গ্রন্থাগারে দান করে দেয়।
কোরেটের ১৮৬৮ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তোলা কিছু ছবি নিয়েই ঢাকায় ‘পোর্টেটস অব লিমা’। তবে এগুলোর মধ্যে তাঁর ভাইয়ের তোলা ছবিও আছে কিনা স্পষ্ট নয়। দাবি করা হয়েছে, এগুলো কোরেটের। তবে কীভাবে আয়োজকেরা নিশ্চিত হলেন যে এগুলো কোরেটেরই তোলা, তাঁর ভাইয়ের ছবি নেই- তাও বুঝে উঠতে পারিনি। যাইহোক, ঢাকায় বসে এমন একটি প্রদর্শনী দেখতে পাওয়া ভাগ্যের বিষয় । অসামান্য প্রিন্ট, ঝকঝক করছিলো, দেখলে মনে হয় আজকে তোলা । তবে তৎকালীন সাদাকালোর ‘ডিগনিটি’ শতভাগ অটুট । গ্লাস নেগেটিভ হওয়ায় ছবিগুলো এখনো অক্ষত রয়েছে।
এক কথায় বলতে গেলে ইউজিন ভ্রাতৃদ্বয়ের ছবিগুলো তৎকালীন পেরুর সমাজ-জীবনের ফটোগ্রাফিক দিনলিপি । ছবিগুলো আমাদেরকে জানায় কীভাবে পেরু তিল তিল করে গড়ে উঠলো, কী ভাবেই বাইরের সংস্কৃতি মিশে গেলো পেরুর ধমনিতে । শুধু তাই নয়, পেরুর নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতেও ছবিগুলো আমাদেরকে সাহায্য করে। এই দুই ভাই শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবিত্তদের ছবি তোলেননি, অাদিবাসী, কৃষক, শ্রমিক ও গৃহপরিচারিকাদের ছবিও তুলেছেন। ছবি তোলার সময় মডেলদের গায়ে জড়িয়ে দেননি ভিনদেশি পোশাক, ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করেননি অবাস্তব সব দৃশ্য।
মানুষ যেখানে যেমন ঠিক তেমনভাবেই মানুষকে নেগেটিভবন্দী করা হয়েছে । যে কারণে আমরা ছবিগুলো দেখে তৎকালীন মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাই । শুধু পেরুর মানুষ-সংস্কৃতি সম্পর্কে নয়- লিমায় পাড়ি জমানো বিদেশিদের খবরও আমরা পেয়ে যাই । চীনা, স্প্যানিশ, অাফ্রিকান ও জাপানি সংস্কৃতির ঝিলিকও আমরা ছবিগুলোতে দেখি। সব ছবিই ইনডোরে তোলা, কিন্তু কৃত্রিম ব্যাকগ্রাউন্ড ববহার করে কিছু ছবিতে আউটডোরের আমেজ আনা হয়েছে।
৪২টি ছবির মধ্যে সম্ভবত নারীর পোর্টেটই ছিলো বেশি । নানা ভঙ্গিতে, বিভিন্ন পোশাক, প্রপ ও ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নারীর ব্যক্তিত্বকে। খোলামেলা পোশাকে এলিয়ে পড়া নারীর ছবি যেমন আছে, চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢাকা নারীর পোর্টেট রয়েছে । এখানেও মডেলের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
আলোচিত্র কতটা শক্তিশালী মাধ্যম তা বোঝা যায় ‘ফোটোগ্রাফিয়া সেন্ট্রাল’-এর সংগ্রহ দেখলে। আলোকচিত্রগুলো একটি সময়কে, ইতিহাসকে স্থির করে রেখেছে। যুগের পর যুগ ইতিহাস-সংলগ্ন মানুষেরা সেই সাদা-কালো ইতিহাস দেখছেন, উপভোগ ও বিশ্লেষণ করছেন। একেকটি ছবি যেন একেকটি ‘মন্যুমেন্ট অব মোমেন্ট’। একেই বলে কালজয়ী শিল্পকর্ম । পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও যা ব্যক্ত করা যেত না, একেকটি ছবি তা করে দিচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)