পেঁয়াজের দাম বাড়লে সবার কষ্ট লাগে, লাগাই স্বাভাবিক। ভোজন রসিক বাঙালির পেঁয়াজ ছাড়া কোনো রান্নাই জমে না। কিন্তু আমার লাগে আনন্দ। প্রচুর আনন্দ লাগে। কেজি একশ টাকার ঘরে গেলে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করে। কারণ একসময় আমরা ছিলাম পেঁয়াজ চাষি। কয়েক বিঘা পেঁয়াজ রোপণ করতাম। পেঁয়াজের বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে হাটে নিয়ে বিক্রি পর্যন্ত সবটার সাথে সশরীরে জড়িত থাকতাম। আমি জানি বীজ কালো জিরার মতো বীজ থেকে পরিপূর্ণ পেঁয়াজে রূপ দিতে একজন চাষির কী পরিমাণ ঘাম ছুটাতে হয়।
আমাদের এলাকায় যত বিত্তশালীর ছেলেই হোক না কেন, পেঁয়াজ রোপণের মৌসুমে তাকে মাঠে নামতেই হয়। মাঠে উপস্থিত থেকে কামলাদের দেখাশোনা করতে হয়। কামলাদের সাথে বসে পেঁয়াজ রোপণে হাত লাগাতে হয়। পেঁয়াজ রোপণের মৌসুমে স্কুলগুলো হয়ে যায় ফাঁকা। ছাত্ররা সব পেঁয়াজের মাঠে। মাঝে মাঝে দেখা যায় টিচাররাও স্কুলে আসেন নাই। মাঠে চলে গেছেন। কারণ একদিন দেরি হলে জমি আর পেঁয়াজ রোপণের উপযোগী থাকে না।
পেঁয়াজ রোপণ করা হয় মাঘমাসে। যখন দেশে সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে। এই হাড় কাঁপানো শীতে চাষিরা পানি ছিটিয়ে জমি তৈরি করেন। আধা-ভেজা মাটিতে একটা একটা করে পেঁয়াজের চারা রোপণ করতে হয়। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল শীতে জমে যায়। সারাদিন বসে থাকায় দুই পা হাঁটুর সাথে লেগে যায়। প্রচণ্ড ব্যথা হয় পায়ে। বেশিরভাগ মানুষের সর্দি লেগে যায়। তবু থামার জো নেই। থামলেই দো আঁশ মাটি শুকে কাঠ হয়ে যাবে। তখন পেঁয়াজের চারা রোপণ করতে গেলে আঙ্গুল ফেটে যাবে। শুকনো মাটিতে চারা যাবে মরে।
অনেক পরিচর্যা শেষে পেঁয়াজ তোলা হয় চৈত্র মাসে। প্রকৃতি তখন কড়া রোদে সাজে। পেঁয়াজের মাঠ খা খা করে। টানা খরতাপ আকাশ-বাতাস পুড়িয়ে দিতে চায়, আপনারা যখন ফেসবুকে গরম গরম বলে চিৎকার করেন, এসির বাতাস খেতে এটিএম বুথে গিয়ে হুদাই ব্যাল্যান্স চেক করেন, তখন পেঁয়াজ চাষিরা মাথাল কিংবা গামছা মাথায় দিয়ে সারাদিন বসে বসে পেঁয়াজ তুলতে থাকে।
তাদের সীমাহীন কষ্টকে আমি খুব ফিল করতে পারি। এজন্যই পেঁয়াজের দাম হাজার টাকা কেজি হলেও আমার কষ্ট হবে না। কষ্ট হবে না কারণ, পেঁয়াজ যখন তোলা হয় তখন পেঁয়াজ বিক্রি হয় পানির দামে। ন্যায্য মূল্যে পেঁয়াজ কিনে দুর্দিনের জন্য সংরক্ষণ করার কোনো পদ্ধতি আমাদের দেশ নেই।
এবারও পেঁয়াজের প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে সাত আটশ’ টাকায়। যেখানে উৎপাদন খরচ হাজার টাকার কাছাকাছি। চাষিরা এবার বস্তায় ভরে ফেলে দিয়েছে পেঁয়াজ। চাষিদের এই দুর্ভোগ আপনাদের তখন স্পর্শ করে নাই। কখনো করে না।
প্রতি বছর ভারত এই সময়ে পেঁয়াজ দেয়। এবার দেবে না। টন টন ইলিশ দিলেও দেবে না। কারণ ভারত নিজেই টানাটানিতে আছে। আফগানিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে তাদের। পূজার দশদিন বন্দর বন্ধ থাকবে। মনে হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতেও এবার পেঁয়াজ পাবেন না ভাইয়েরা।
তবে এই যে পেঁয়াজের দাম বাড়ল, এতে কি কৃষকরা লাভবান হবে? হবে না। কারণ যারা প্রান্তিক চাষি তাদের হাতে টাকা পয়সা থাকে কম। পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ বেশি। কৃষকদের হাতে নগদ টাকা থাকে না। বিধায় তারা সুদের উপর টাকা নিয়ে কিংবা ধার দেনা করে পেঁয়াজ চাষ করেন। তাদের সাথে চুক্তি থাকে, পেঁয়াজ তুলেই সুধে আসলে টাকা পরিশোধ করতে হবে। ফলে পেঁয়াজ তুলেই সব বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয়। এই সময় আসতে আসতে প্রকৃত চাষিদের ঘরে আর পেঁয়াজ থাকে না। চলে যায় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। সিন্ডিকেটের হাতে।
এছাড়া প্রতিবছর ক্যাসিনোর চেয়েও বড় জুয়া চলে এই পেঁয়াজ নিয়ে। দুই বছর আগে পেঁয়াজের মণ হয়েছিল চার হাজার টাকা। তাই দেখে পরের বছর সাহস করে অনেক কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি না করে সংরক্ষণ করেছিলেন। সে বছর আর দাম বাড়েনি। বিক্রি করতে হয়েছে হাজার বারোশ’ টানা মণে। চাষিদের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সাত আটমাস সংরক্ষণ করলে এমনিতেই প্রতি মণে কয়েক কেজি কমে যায়। তার উপর পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা খুবই ঝামেলার কাজ। নতুন বউয়ের মতো আদর যত্ন করে রাখতে হয়। সেই পেঁয়াজ যদি বিক্রি হয় উৎপাদনের চেয়ে কম মূল্যে তাহলে চাষিদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।
পেঁয়াজের কেমন ফল হলো কিংবা দাম কেমন পেলো তার উপর চাষিদের অনেক কিছু নির্ভর করে। মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে কি না, ঘরের চালে নতুন টিন উঠবে কি না, সদ্য ইন্টার পাশ করা ছেলে শহরে থেকে কোচিং করতে পারবে কি না, বউ নতুন শাড়ি পরে বাবার বাড়ি যেতে পারবে কি না কিংবা আগামী বছর পেঁয়াজ আবাদ করা যাবে কি না…? এমন অনেক কিছু নির্ভর করে পেঁয়াজের ফলন ও দামের উপর।
গত বছরও খুব একটা দাম বাড়েনি। ফলে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে ধরা খেয়েছিলেন চাষিরা। এবার পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এখন কোনো চাষির ঘরে পেঁয়াজ নেই। সব চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। এই যে তিন সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ পেঁয়াজ। চাষিদের কোনো লাভ নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তাদের কোনো প্রাপ্তি নেই।
বাংলা সিনেমা দেখেছি, গরীব বাবা কষ্টে শিষ্টে সন্তানের লেখা পড়া করায়। সন্তান বড় হয়। চাকরি পায়। বিয়ে করে। বউ-শাশুড়ির পাল্লায় পড়ে বাবাকে ভুলে যায়। সন্তানের আয়ে বউমা আনন্দ ফুর্তি করতে থাকে। বাংলার পেঁয়াজ চাষিদের অবস্থা ঠিক তেমন। তবে সিনেমার শেষে দেখা যায় কেউ একজন বাবার পক্ষ নিয়ে সন্তানের ভুল ভাঙায়। ধোলাই খেয়েই হোক আর যেভাবেই হোক সন্তান তার ভুল বুঝতে পারে। বাবার কাছে ফিরে আসে। কিন্তু পেঁয়াজ চাষিদের সুদিন আর ফেরে না। কারণ চাষিদের জীবন বাংলা সিনেমা না। চাষিদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। চাষিদের হয়ে কর্তৃপক্ষের ভুল ভাঙানোর কেউ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)