পেঁয়াজের ঝাঁজ নিয়ন্ত্রণ সূত্র

চলতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৬০ টাকা কেজি। তখন পেঁয়াজ চাষিরা কান্না করেছে। অনেক কৃষক এই সময়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি। অনেক কৃষক তার ছেলেকে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারেননি। আবার অনেকে শোধ করতে পারেনি ঋণের টাকা।

এর কারণ হলো, ৭০০-১১০০ টাকা মণে পেঁয়াজ বিক্রি করলে কৃষকের লাভ তো থাকেই না, বরং প্রচুর লোকসানের মুখে পড়তে হয়। পেঁয়াজের বীজ বপন থেকে শুরু করে চারা রোপণ ও ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, অনেক জনবল খাটাতে হয়। এছাড়া জমি চাষের উপযোগী করা, বীজতলা নির্মাণ, সার-বিষ প্রয়োগ, বীজ ক্রয়, নিড়ানি দেওয়াসহ নানা খাতে প্রায় সারা বছর পেঁয়াজের পেছনে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয় কৃষককে। ফসল তোলার পরও সেটাকে বিক্রির উপযোগী করতে শ্রমিক খাটাতে হয়। সব মিলিয়ে পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ প্রচুর। এই খরচের টাকা বেশির ভাগ কৃষক সুদ-লোন কিংবা ধার নিয়ে থাকেন।

ফলে পেঁয়াজের দাম মণ প্রতি ২০০০ টাকার কম থাকলে কৃষক বিক্রি করতে চান না। এবারও যেহেতু পেঁয়াজের দাম ৭০০-৮০০ টাকার বেশি উঠছিল না, কৃষকও পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে বাধাই তথা ঘরে সংরক্ষণ করে রাখলেও দ্রুত পেঁয়াজ পচতে থাকে। এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ায় পচনের হার ছিল মারাত্মক। ফলে উভয় সংকটে পড়ে বেশিরভাগ কৃষক লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছেন। এই যে এবার পেঁয়াজের দাম আট হাজার টাকার উপরে উঠলো, এতে কিন্তু কৃষকের লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে আড়তদার ও মজুদ ব্যবসায়ীদের। তার মানে দুই-তিন হাজার মানুষের লাভের বিপরীতে লোকসান হয়েছে পুরো দেশের। কৃষক হারিয়েছে ন্যায্য মূল্য। জনগণকে কিনতে হয়েছে চড়া মূল্যে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তথাপি ১৬ কোটি মানুষকেই বিপদে পড়তে হয়েছে।

‘ঝাঁঝ নিয়ন্ত্রণ সূত্র’ই পারে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে
পেঁয়াজের ঝাঁঝ নিয়ন্ত্রণ সূত্র অনুসরণ করলে কৃষক, জনগণ, সরকার তথা ১৬ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। সারা বছর পেঁয়াজের দাম থাকবে স্থিতিশীল। ফলে এটাকে ‘ঝাঁঝ নিয়ন্ত্রণ’ সূত্র বলা যেতে পারে।

সূত্রটা হলো:
“আমাদের দেশে পেঁয়াজের সিজন থেকে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাস থেকে দেশি পেঁয়াজ ২৫০০ টাকা প্রতি মণে বিক্রি করবে কৃষক। কৃষকের ঘর থেকে সর্বসাধারণের ব্যাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে যে আড়ৎদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কাজ করে তারা সীমিত লাভ রেখে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করবে। দেশি পেঁয়াজ টানা চার/পাঁচ মাস বিক্রি হবে। পেঁয়াজের ফলন ও চাহিদা বুঝে সরকার একটা মাস নির্ধারণ করে দেবে। সেই মাসের ভেতর সব দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হবে। যখন কারো ঘরে, কারো আড়তে আর পেঁয়াজ থাকবে না তখন সরকার আমদানি শুরু করবে। ভারত, মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান থেকে আমদানি করতে প্রতি কেজি পেঁয়াজে খরচ পড়ে ৫০ টাকার মতো। আড়ৎদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লাভ রেখে বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি করবে ৬০/৬৫ টাকা কেজিতে। সারা বছর পেঁয়াজের ঝাঁঝ থাকবে নিয়ন্ত্রিত।”

ব্যাখ্যা
১. দেশি পেঁয়াজ স্বাদে, মানে, গুণে অনেক ভালো। এই পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি মোটেও বেশি দাম না। আবার একেবারে কম দামও না। যখন ৪০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি হয় তখন কৃষক কান্না করে। আবার যখন ২৫০ টাকা কেজি ওঠে তখন জনগণ কান্না করে। ফলে পেঁয়াজের ঝাঁঝে কাউকে না কাউকে কান্না করতেই হয়। অথচ যতদিন বাজারে আছে ততদিন ৭০ টাকা করে পেঁয়াজ বিক্রি হয়, না কৃষক না জনগণ কাউকেই কান্না করতে হবে না। ৪০+২৫০=২৯০%২=১৬৫, গড়ে ১৬৫ টাকা কেজিতেও জনগণকে পেঁয়াজ খেতে হবে না।
২. প্রতিটি থানা কৃষি অফিসের মধ্যমে সরকার দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ যাচাই করবে। পেঁয়াজ ফুরিয়ে যাবার এক মাস আগেই আমদানি শুরু করবে।
৩. ইলিশ ধরা নিষেধের মতো করে সরকার ঘোষণা দেবে, এত তারিখের মধ্যে সব দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হবে। এরপর আর দেশি পেঁয়াজ বেচা-কেনা করা যাবে না।
৪. দেশি পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেলে বাজারে বিদেশী পেঁয়াজ আসবে। যেহেতু বিদেশি পেঁয়াজের মান কম ভালো সেহেতু সেটা কম দামে বিক্রি হবে।
৫. ধরি, দেশি পেঁয়াজ পাঁচ মাসে শেষ হয়ে গেলো। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজার থাকলো দেশি পেঁয়াজের দখলে। এরপর আসলো বিদেশি পেঁয়াজ। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বিদেশি পেঁয়াজ দিয়ে।

ডিসেম্বরে এ দেশের মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ উঠে যাবে। যদিও মুড়িকাটা পেঁয়াজ দিয়ে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলা সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে মুড়িকাটার পাশাপাশি বিদেশি পেঁয়াজ দিয়ে চলবে বাজার। মুড়িকাটা পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা হলেও কৃষকের লাভ থাকে। তখন দেশি মুড়িকাটা ৪৫ অথবা বিদেশিটা ৫০ এমন রেটে চলতে পারে।

সীমাবদ্ধতা
এই সূত্রের একটি বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা হলো, পেঁয়াজের সিজন তথা এপ্রিল মে মাসে যদি ২৫০০ টাকা মন পেঁয়াজ থাকে তাহলে সবাই চাইবে সিজনে বিক্রি করে দিতে। ফলে সিজনে বেশি বিক্রি হলে শেষের দিকে আবার ঘাটতি দেখা দিবে। ফলে আবার অস্থিতিশীল হয়ে যাবে বাজার।

এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, পেঁয়াজের দাম গড়ে ২৫০০ টাকা নির্ধারণ করে, সিজন তথা মে মাসে হতে পারে ২৩০০ টাকা মণ। এপ্রিলে হতে পারে ২৪০০ টাকা মণ, জুনে ২৫০০, জুলাইতে ২৬০০, আগস্টে ২৭০০ টাকা মণ। ফলে ঘরে রাখলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বেশি পাবে মণে। না রাখলে ৫০০ কম। যাদের টাকা দরকার তারা সিজনে বেঁচে দেবে। বাকিরা রেখে দেবে। এবং নির্দিষ্ট চার কিংবা পাঁচ মাসের ভেতর সব পেঁয়াজ বেচে দিতে হবে।

এভাবে বাণিজ্য, কৃষি কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটু সচেতন, আন্তরিক আর উদ্যমী হলে কৃষককে বাঁচাতে পারে লোকসানের হাত থেকে। জনগণকে বাঁচাতে পারে পেঁয়াজের ঝাঁঝ থেকে এবং সরকারকে বাঁচাতে পারে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

দেশি পেঁয়াজপেঁয়াজপেঁয়াজ চাষিপেঁয়াজের ঘাটতিপেঁয়াজের দামপেঁয়াজের বাজারপেঁয়াজের মূল্যভারতীয় পেঁয়াজভারতের পেঁয়াজমিশরীয় পেঁয়াজ