পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি আয়: জাতিসংঘ প্রতিবেদনে দ্বিমত অর্থনীতিবিদদের

পৃথিবীর ৬৪ দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ঘণ্টা প্রতি পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি আয় করেন এবং মাসিক আয়ের ক্ষেত্রেও এই ব্যবধান অত্যন্ত কম বলে জাতিসংঘ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, পুরুষ প্রধান বাংলাদেশে সাধারণত নারীদের আয় কমই। তাছাড়া পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেও নারীরা অবহেলিত। পোশাক খাতের বাইরে নারীদের অংশগ্রহণও খুব কম। নারী ও পুরুষের আয়ে অনেক বৈষম্য রয়েছে। অতএব পুরুষের চেয়ে নারীদের আয় বেশি – এই তথ্য বাস্তবে মিলে না। এতে ভরসাও করা যায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এই প্রতিবেদনটি আমি এখনো দেখিনি। কিসের ভিত্তিতে, কিভাবে প্রতিবেদন করা হয়েছে তা জানিনা। তবে সাধারণভাবে যদি বলি তাহলে এটা মিলবে না।

“এটা নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে বিশেষ কোনো গ্রুপের জন্য করা হয়ে থাকতে পারে। স্বাভাবিক যদি বলি এটা ঠিক হয় না।”

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ।

 

তার ব্যাখ্যা, ‘বাংলাদেশ এখনও পুরুষপ্রধান দেশ। একানে পুরুষরাই আয় করেন। বলতে গেলে মেয়েরা আয়ই করেন না। মেয়েদের কাজকে যদি মনিটারাইজ করেন, সেটা একটা বিষয়।

তবে জাতিসংঘের এসব তথ্যের ওপর খুব বেশি ভরসা নেই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, তারা (জাতিসংঘ বা আইএলও) কিছু স্যাম্পল নিয়ে জরিপ করে থাকেন। তারা কোথায় কী স্যাম্পল নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন জানি না।

“যদি বলি বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের অবস্থান ভাল; সেটা ঠিক হবে না। কারণ পোশাক কারখানার বাইরে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম। যেমন উৎপাদন বা সেবা খাত কিংবা ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য খাতে কয়জন নারীই বা কাজ করেন।”

সাবেক তত্ত্বাবধারক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এখন এসব বিষয় না দেখে যদি বলা হয়, বাংলাদেশে পুরুষদের তুলনায় নারীরা খুব উন্নত অবস্থায় আছে তাহলে বলবো, এটা ভুল ধারণা।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। এই মুহূর্তে খুব একটা বলতে পারছি না। তবে আমার ধারণা যে, নন ফরমাল সেক্টরে মজুরিতে এখনো বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশে শ্রম আইন রয়েছে যেখানে পরিস্কার বলা হয়েছে নারী-পুরুষ একই রকম কাজ করলে সেক্ষেত্রে মজুরি প্রদানে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। এটা আইন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারীরা কাজ করেন ইমফরমাল সেক্টরে। যেমন ধরেন কৃষি, নির্মাণ শিল্পে ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মজুরিতে অনেক বৈষম্য রয়েছে। এক্ষেত্রে এই ধারণা করা হয় যে, পুরুষরা বেশি কাজ করেন আর নারীরা কম কাজ করেন। এবং নারীরা ভারি কাজ করতে পারে না।’

শাহীন আনাম,নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

কিসের ভিত্তিতে জাতিসংঘ এই প্রতিবেদন করেছেন সে বিষয়ে তারা এখনো পরিস্কার নয় জানিয়ে শাহীন আনাম বলেন, ‘এটা এখনো ভালভাবে দেখা হয়নি। তারা ফরমাল এবং ইনফরমাল খাত একসাথ করে প্রতিবেদন করছে কি না তা দেখতে হবে। কারণ আলাদা আলাদা যদি করা হয় তাহলে অবশ্যই পারিশ্রমিকের মধ্যে একটা বৈষম্য পাওয়া যাবে।’

পুরুষের চেয়ে নারীর ঘণ্টা ভিত্তিতে আয় বেশি পান যে তথ্য দিয়েছেন এতে আপনাদের যুক্তি কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই খাতে দীর্ঘদিনের পথচলায় এমন কোনো তথ্য এই পর্যন্ত আমরা পাইনি।’

সম্প্রতি জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে বলেছে, পৃথিবীর ৬৪ দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতি ঘণ্টায় পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আয় করেন। মাসিক আয়ের ক্ষেত্রেও এই ব্যবধান অত্যন্ত কম। পুরুষদের চেয়ে নারীদের মাসিক আয় কম মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ।

গত ১৬ জানুয়ারি জাতিসংঘের ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্ভাবনা ২০২০’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, পার্ট-টাইম/ফুল-টাইম চাকরি, সরকারি/বেসরকারি চাকরি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই এই জরিপ চালানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ঘণ্টা হিসেবে একই কাজে পুরুষদের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি পারিশ্রমিক পান, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের মতো উচ্চ-আয়ের দেশের চেয়েও বেশি।

প্রতিবেদনটিতে ৬৪ দেশে নারী-পুরুষের মাসিক ও প্রতি ঘণ্টার আয়ের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৮-১৯ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশ্ব পারিশ্রমিক প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানায় জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ