একবার সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় মহাশয় সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে কোনো এক জলসা শুনতে যাবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করতে থাকেন। শরৎচন্দ্র দিলীপকুমারকে বললেন, না ভাই ও সব কালোয়াতী গান-টান আমি বুঝি না, তুমিই যাও।
দিলীপকুমার নাছোড়বান্দা। কেবল বলতে থাকেন, দাদা, এ সে রকমের জলসা নয়। ঘরোয়া ব্যাপার, সেখানে যে কালোয়াতটি আসবেন তিনি একজন খুব উঁচুদরের গুণী, আপনি তার গান শুনলে মোহিত হয়ে যাবেন। চমৎকার গান, একবারটি শুনেই আসবেন নয়, চলুন।
শরৎচন্দ্র সব শুনে একটু চিন্তিতভাবে বলে উঠলেন, হুঁ, তুমি যা বলছ দিলীপ, সবই বুঝলুম, গুণী লোক, গানও গায় ভালো, কিন্তু থামে তো?
দিলীপকুমারসহ উপস্থিত সকলে শরৎচন্দ্রের এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন, কিন্তু শরৎচন্দ্রের এই প্রশ্নটি হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
আমরা অর্থাৎ বাঙালিরা অনেক কিছু শিখেছি কিন্তু কোথায় থামতে হয় সেইটাই শিখিনি। আমাদের গান থামে না, বক্তৃতা থামে না, কথা থামে না, উপদেশ থামে না, ধর্মীয় বয়ান থামে না, গালাগালি তো থামতেই চায় না—এ এক মরণ জ্বালা।
আমরা ছোটবেলা থেকে উপদেশ শুনতে আরম্ভ করলাম—তা আর থামল না। গুরুজনরা আমাদের ভালো করবার জন্য এত উপদেশ বিতরণ করলেন যে, সমস্ত করণীয় কাজ ভুলে গেলাম। এ যেন সরকারের নিত্যনতুন আইন পাস ও তা অনুসরণের নির্দেশ—সমস্ত ধারাগুলো মুখস্থ থাকলে ভালো উকিল হওয়া যায়, টেলিভিশনের টকশোতে ডাক পাওয়া যায়, আর তা না হলে আহাম্মক পাবলিকের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে হয়। এই করো না, তাই করো না, এই কর, তাই কর বলতে বলতে আমাদের আর কোনো কিছু করতে হলো না, একেবারে কাজের বাইরে চলে গেলাম! তাঁরা যদি উপদেশ একটু স্বল্পমাত্রায় দিতেন—উপকার হতো। মাত্রা বাড়াতেই বিপদ হয়ে গেল। ওভারডোজ আমাদের হজম হলো না!
এদের পর আরম্ভ হলো মাস্টার সাহেবদের উপদেশ। তারপর অফিসের কর্তাদের, তারও পরে বন্ধুদের। সর্বশেষ বাড়ির লোকদের। কেউ কখনও থামলেন না। এদের সকলের নজর এড়িয়ে একটু ড্রইংরুমে নিঃসঙ্গ বসে টিভি দেখবেন? সেখানেও ‘জাতীয় চাপাবাজদের’ নিয়মিত উপদেশ বর্ষণের ঠ্যালায় মাথা-টাথা সব গুলিয়ে যাবে!
কাজ-কর্ম সমাজ-সংসার সব ত্যাগ করে ধর্মঘট তো আর করা যায় না! তাতে রাজনীতিকদের জীবন চলে; কিন্তু আমাদের মতো খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন চলে না! আমাদের করে খেতে হবে, লড়ে যেতে হবে!
অথচ কারোর জীবনেই কোনো দুর্ভোগ হয় না, যদি যথাস্থানে থামার আর্টটা সকলের জানা থাকে। গরগর করে হম্বিতম্বি পর্যন্ত ভালো—কিন্তু হুট করে কারও নাকে ঘুষি বসিয়ে দিবেন না কখনও, তা হলেই সর্বনাশ। প্রতিপক্ষকে কখনও কিলের ওজন বুঝতে দিতে নেই। বাকযুদ্ধ করে, মুখে মুখে যত খুশি রাজা-উজির মারুন, কেল্লা ফতে করুন, কিন্তু খবরদার নিজে থেকে কখনও সত্যি যুদ্ধ করতে যাবেন না—মারা পড়বেন। কিন্তু মজা এমন যে একবার পরিপূর্ণ আবেগ এলে তার বেগকে ঠিক তালমাফিক থামাবার কায়দা দেশবাসীর জানা নেই।
মাত্র কয়েক বছর আগেও এ দেশে থিয়েটার, যাত্রা, সার্কাস চলত সারারাত ধরে। ভোরের দিকে ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে দর্শকদের, চড়চড় করে রোদ উঠে গেল, তখনও আলিবাবার নাচ চলছে। আবার এর মধ্যে মজাও দেখেছি, নিমীলিতচক্ষু নিদ্রাকাতর সঙ্গীকে ধাক্কা মেরে তার বন্ধু দর্শক বলছে, এই চোখ চা না—দেখ না, কী দুর্দান্ত ড্যান্স হচ্ছে। সে বেচারী ঈষৎ চক্ষুটি খুলেই আবার বুজে ফেলল এবং হাই তুলতে তুলতে বলে উঠল, ও আর দেখব কী? বেটারা সব বাদ দিয়ে এখন প্লে করছে। বলেই সে আসনেই এলিয়ে পড়ল!
ঋষিরা বলেছেন—চরৈবতি- আরও এগিয়ে চল বাবা, থেমো না। তবেই ব্রহ্মাকে উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু আমরা সেদিকে না এগিয়ে যতসব বিদঘুটে ব্যাপারের দিকে এগিয়েছি। অনেক ব্যাপারে থেমে যাওয়াটা যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়—এটা আমাদের দেশে কে কাকে বোঝাবে?
শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউই তা বোঝেন না। বক্তা বক্তৃতা দিতে উঠলেন। বিশেষ অধ্যাপক বা কাগজের সম্পাদক হলে তো কথাই নেই—থামবার নাম করবেন না!
লোকে অতিষ্ঠ হয়ে প্রথমে মেঝেতে পা ঘষল, তারপর ঘনঘন বেমক্কা জায়গায় করতালি দিতে শুরু করল, আসনের অর্ধেক খালি হয়ে গেল—তবু হুঁশ নেই। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান শ্রোতাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে তিনি মহাপ্রস্থান করবেন। ভবিষ্যতে আর কোনো লোক এসে যে দুটো জ্ঞানের কথা বলে আপনার মাথার ফাঁক ভরাট করে যাবেন—সে সুবিধা তারা দেবেন না!
আমাদের এক ‘ভাবী রাষ্ট্রনায়ক’ লন্ডনে বসে অত্যন্ত ওজনদার সব বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। কোন প্রয়োজন নেই, কেউ চায়নি, তবু আরেকজন দিচ্ছেন তার জবাব। আমাদের ‘ক্ষমতা বঞ্চিতরা’ ‘কঠিন আন্দোলনের’ প্রলাপ সম্বলিত বক্তৃতা চালিয়েই যাচ্ছেন। অন্যদিকে মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য মাঝেমাঝেই দিকভ্রান্ত সব কথামালা উচ্চারণ করে চলেছেন। সত্যি বলতে কি, কয়েকজনের কাণ্ডজ্ঞানহীন বিরামহীন বক্তৃতাপ্রবাহ মানুষকে অস্থির করে তুলেছে।
সম্প্রতি শফি হুজুর মেয়েদের ফোর-ফাইভের বেশি পড়ালেখার দরকার নেই বলে বয়ান দিয়েছেন! এমন বয়ান তিনি আগেও দিয়েছেন। কিন্তু এবার সামাজিক মাধ্যমে এই উক্তিটি নিয়ে রীতিমত ট্রল হচ্ছে! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, শফি হুজুর বলেছেন বলেই সরকার মেয়েদের ফোর-ফাইভের বেশি পড়ানো বন্ধ করে দেবে?
ফালতু বিষয় নিয়ে মাতামাতিতে আমাদের জুড়ি নেই!
শফি হুজুর সাহেব এই বক্তৃতা কেন ঝাড়লেন, এতে কার কী উপকার হলো আল্লাহ মালুম। কিন্তু তার এই বক্তৃতা ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তি খোয়াতে যে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে— তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে সরকার বিরোধীরা শফি হুজুরের এই বক্তৃতাকে ধরে সরকারকে এক হাত নিচ্ছেন! বিরোধীরা বিরাট একটা মওকা পেয়েছেন—এমন একটা ভাব ধরে নড়েচড়ে উঠেছেন! কারণ মাত্র কয়েক মাস আগে শফি হুজুরের সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন!
উল্লেখ্য, শফি হুজুর, কওমি, হেফাজত আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অনেকে একাকার করে দেখেন! তাদের জন্য শফি হুজুর এবং তার এই সব বয়ান বিরাট বড় একটা মওকা!
যথাসময়ে যথাস্থানে থামতে না জানলে পরিণতি কী হয়, তার প্রমাণ আমরা অতীতে নানা ঘটনায় দেখেছি।তারপরও আমরা কেউ কিছু শিখছি না!
চতুর্দিকে আমাদের এত বিপদ ঘনিয়ে আসছে কেন? কারণ আমরা থামতে জানি না। নাচ, গান বক্তৃতা, গলাবাজি, হুজুগ, মিথ্যাচার, পরচর্চা, আন্দোলন, শোভাযাত্রা, টকশো, গোলটেবিল বৈঠক, শোকসভা, গালাগাল কিছুই বাদ পড়ছে না! অবাধ, নিরঙ্কুশ, স্বাধীন ও অশ্রান্তভাবে একটা বিষয় নিয়েই অবিরাম মোচ্ছব চালিয়ে যাচ্ছি—থামবার নাম নেই আমাদের।
কিন্তু থামা দরকার। রসিক মাত্রই কোথায় থামতে হয়, ঠিক জানেন। ঈশ্বরকে বলা হয়—রসো বৈ সঃ অর্থাৎ তিনি প্রকৃত সুরসিক! তার প্রমাণ—যথাসময়ে তিনি আমাদের নাচনকুঁদন ও আস্ফালনকে একেবারে জন্মের মতো থামিয়ে দেন!
তবে থামিয়ে দেয়ার চেয়ে নিজে নিজে যে থামতে জানেন—সেই প্রকৃত বিচক্ষণ বা জ্ঞানী। হায় এমন বিচক্ষণ বা জ্ঞানী মানুষ আমরা কোথায় পাব?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)