নারী সহিংসতা বিরোধী মুুভমেন্ট: সিনেমায় প্রতিবাদ

গ্রাম থেকে শহর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মস্থল। আরো মোটাদাগে বললে সারা বিশ্বের প্রায় সবখানেই নারী সহিংসতার ভয়বহতা দৃশ্যমান। কোথাও নিরাপদে নেই নারী। ঘরে, বাইরে কোথাও স্বস্তিতে নেই নারী। তবে অনবরত যৌন নিপীড়ন আর হয়রানি থেকে বাঁচতে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই তা দেখা গেছে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ফেলে দেয়া হ্যাশ ট্যাগে ‘মিটু’ মুভমেন্টে। এবার বাংলাদেশেও নারী সহিংসতা ঠেকাতে এক ভিন্ন উদ্যোগ নিলেন সিনেমা নির্মাতারা।

নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে সুদূর প্রসারী ভাবনা মাথায় নিয়েছেন দেশের আট তরুণ নির্মাতা। না, তারা শুধু সোশাল মিডিয়ায় হ্যাশ ট্যাগে প্রতিবাদ জানাবেন না, বরং নারী সহিংসতার নানা দিক তুলে ধরবেন অসংখ্য মানুষের চোখের সামনে। ভিজ্যুয়াল মিডিয়াতে। মূলত, ক্যামেরা আর গল্পকে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চলেছেন তরুণ এই নির্মাতারা। এটাকে তারা দেখছেন মুভমেন্ট হিসেবে। যার নাম দিয়েছেন ‘আই স্ট্যান্ড ফর ওমেন’।

‘সিনেমা হোক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবের হাতিয়ার’-এরকম স্লোগানকে ধারণ করে নিজের ঘাঁটের পয়সা খরচ করে নারী সহিংসতা নিয়ে সচেতনতামূলক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি করেছেন আট তরুণ নির্মাতা। তাদের সিনেমার বিষয় বস্তু নারী সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি।

সিনেমা কীভাবে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলবে?-এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো আট নির্মাতার একজন জসিম আহমেদকে। তিনি বললেন, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি সবার এক ধরনের দায় বোধ রয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা যারা সিনেমা বানাই তারা এই ‘আই স্ট্যান্ড ফর ওমেন’ মুভমেন্টের সাথে সহমত পোষণ করি। বিশ্বাস করি, এই সিনেমাগুলো দেখার পর যে কেউ মেয়েদের সাথে বাজে ব্যবহার করতে ভয় পাবে। একই সঙ্গে মেয়েদের মধ্যেও এই সচেতনটা ছড়িয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ।

সিনেমা দিয়ে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে মুভমেন্ট তৈরির উদ্যোগটা কার মাথা থেকে এলো, জানতে চাইলে জসিম আহমেদ বললেন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আফজাল হোসেন মুন্নার দেওয়া একটি পোস্ট থেকে শুরু হয় এই কার্যক্রম। তিনিই মূলত এই মুভমেন্টের আইডিয়া দেন। তার ওই পোস্টে তিনজন নির্মাতাকে ছবি বানানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য নির্মাতাদের মধ্যে। প্রথম ধাপে আমরা আটজন নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধের বিষয় নিয়ে একটি করে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করি। এই মাসেই ছবিগুলোর প্রিমিয়ার করবো। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতিও এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপেও অনেক নির্মাতা নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধের বিষয় নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে দিয়েছেন জানিয়ে জসিম আহমেদ জানান, আমরা যাদের থেকে বেশি আশা করেছিলাম তাদেরকে এই মুভমেন্টে পাইনি। এটা আমাদের জন্য একটা কষ্টের জায়গা। কিন্তু তারপরও আমরা আশাবাদী, কারণ দ্বিতীয় কিস্তিতে ছবি বানাতে অনেকে নিজ আগ্রহেই এগিয়ে এসেছেন। অনেকে কাজও শুরু করে দিয়েছেন।

‘আই স্ট্যান্ড ফর ওমেন’ মুভমেন্টের জন্য যে কেউ সিনেমা বানাতে পারবেন জানিয়ে নির্মাতা জসিম আহমেদ এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আই স্ট্যান্ড ফর ওমেন’ একটি স্বাধীন প্লাটফর্ম। এখানে যে কেউ তার আইডিয়া নিয়ে এসে সিনেমা বানাতে পারেন। শুধু সিনেমাটিক লেঙ্গুয়েজ হলেই হবে তার বানানো চলচ্চিত্রটির। কেউ তার কাজে ইন্টারফেয়ার করবে না। তিনি চাইলে তাকে আমরা চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ইকুপমেন্ট এমনকি কাস্টিং পর্যন্ত ঠিক করে দিতে পারবো। কিন্তু তার সাথে আমাদের মুভমেন্টের ঠিক করে দেয়া কন্টেন্টের হেরফের হলে হবে না। মানে আমাদের মুভমেন্ট, ইস্যু এবং সেন্টিমেন্টের সাথে কন্টাডেক্টরি হলে কিন্তু চলবে না। এছাড়া আমাদের থেকে যে কোনো ধরনের হেল্প চাইলে আমরা করবো।

এরকম কাজে স্টার কাস্ট নিয়েছেন অনেকে। স্টার কাস্টিংয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ‘দাগ’ নির্মাতা আরো জানান,প্রচুর মানুষকে কানেক্ট করতেই আমিসহ অনেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্যতে স্টার কাস্ট নিয়েছি। কারণ তারকাদের মানুষ ভালোবাসে, তাদের কথাকেও খুব গুরুত্ব দেয়। স্টারদের কাস্ট করার অর্থই হলো তাদের কথার গ্রহণ যোগ্যতা আছে মানুষের কাছে।

এই মুভমেন্টের সাথে নিজেদের অ্যাটাচমেন্টের কথা তুলে ধরে তিনি আরো জানান, এই মুভমেন্টের সাথে আমরা যারা জড়িত তারা গত তিন মাস ধরে অন্য কিছু একটা করতে পারছি না। বিশেষ করে মুন্নাতো একেবারে লেগে আছে। পোস্টার বানানো থেকে শুরু করে কখনো কখনো এডিট প্যানেলেও তাকে বসতে হচ্ছে। আসলে প্রথম ধাপে আমরা যে কয়জন মুভমেন্টের জন্য সিনেমা বানালাম প্রত্যেকের ডেডিকেশনটা ছিলো দেখার মতো।

সহিংসতার বিরুদ্ধের এই যুদ্ধে মিডিয়ারও বিশেষ দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন জসিম। তিনি বলেন, চারদিকে যে সহিংসতার খবর শোনা যাচ্ছে তাতো একদিনে দূর করা সম্ভব না। টেলিভিশন, নিউজ পেপার বা সংবাদ মাধ্যমে যদি এই বিষয়গুলোকে আরেকটু গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলে ধরা হয় তাহলে ধীরে ধীরে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। আমি বিশ্বাস করি, এভাবে ধীরে ধীরে একটা সময়ে গিয়ে সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে।

‘আই স্ট্যান্ডফর ওমেন’-এর উদ্যোক্তা মুন্না

মুভমেন্টের উদ্যোক্তা আফজাল হোসেন মুন্নার বানানো স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির নাম ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য গার্ল’ এবং জসিম আহমেদের ‘চকলেট’সহ মোট আটটি চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার হবে চলতি মাসেই। এই দুই নির্মাতা ছাড়াও ‘আই স্ট্যান্ড ফর ওমেন’ মুভমেন্টে দেখানো আছে খিজির হায়াত খানের পরিচালনায় ‘সে নো টু রেপ’, প্রতীক সরকারের ছবি ‘মুখোশ’, আশিকুর রহমানের পরিচালনায় ‘অসম্ভাবিত’, সাকি ফারজানার পরিচালনায় ‘দ্য পার্ক, দ্য বেঞ্চ অ্যান্ড দ্য গার্ল’, আসিফ খানের পরিচালনায় ‘দ্য মাদার’ এবং রাজু আহসানের পরিচালনায় ‘লিপস্টিক’ ছবিগুলো।

ইন্তেখাব দিনারজসিম আহমেদতিশানারীমুন্নামুভমেন্টমৌসুমী হামিদযৌন হয়রানিলিড বিনোদনস্বল্পদৈর্ঘ্য