নারীর অবেতনমূলক কাজের স্বীকৃতি কোন পথে?

দেড় বছর আগেও প্রীতি রহমানের সময়টা এমন কষ্টের ছিল না। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করছিলেন স্বাচ্ছন্দের সাথে। ক্লাস-গবেষণা আর সংসার নিয়ে দিনগুলো বেশ ভালই যাচ্ছিল। বিয়ের পর কোলজুড়ে আসা সন্তানকে নিয়ে দিনগুলো ছিল সবচেয়ে আনন্দের।

কিন্তু সময় বদলাতে শুরু করলো মাতৃকালীন ছুটি কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগ দেয়ার পর। প্রীতির জন্য কাজে মন বসানো কঠিন হয়ে উঠছিল। ছয় মাস সন্তানকে নিজের মতো করে লালন-পালন করার পর কাজে গিয়ে মনটা সবসময় অস্থির থাকতো। সেসঙ্গে বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য, সংসারের যাবতীয় কাজের জন্য, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর মতো যোগ্য সহযোগী না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিলেন না।

ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরূপ চোখে পড়তে শুরু করেন। সাংসারিক বিষয়গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় সহজভাবে না দেখার কারণে প্রীতির প্রতি কঠোর হতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে, চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত।

‘কি করবো! গত দেড় বছরের বেশি কোনো গবেষণা কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারিনি। সাংসারিক নানা কাজের মধ্যে পড়ে প্রায়ই প্রস্তুতি ছাড়া ক্লাস নিতে হতো। একাডেমিক কোন কার্যক্রমেও অংশ নিতে পারছিলাম না। বাসায়, পেশায় কোথাও সেভাবে সহযোগিতা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’

প্রীতি রহমানের মতো অনেক চাকরিজীবী নারীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে এরকম কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ সামাজিক কর্মকাণ্ডের মিথস্ক্রিয়ায় তারা অবেতনভুক্ত সেবামূলক কাজকে অগ্রাধিকার দেন পরিবার ও সমাজের স্বার্থে। ছেড়ে দেন তাদের কাঙ্ক্ষিত পেশা, যোগ্যতা প্রমাণ করার স্বপ্ন।  প্রীতির মতো তারা অনেকে অনুভব করেন যে কর্মক্ষেত্রে শোভন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের (ডে-কেয়ার সেন্টার) মতো ব্যবস্থা থাকলে চাকরি ছাড়তে হতো না।

ড. সাদেকা হালিম

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নারীদের এই ধরনের পরিস্থিতি সামাজিকীকরণের ফসল। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর সমাজ মনে করে গর্ভে সন্তান ধারণের মতো সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বও শুধু মায়ের। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের সমাজ নারীর কাজ সম্পর্কে সনাতন ধারণা পোষণ করছে। এখনো পুরুষ শাসিত সমাজ মনে করে, নারীদের কাজ সন্তান উৎপাদন, রান্নাবান্না করা, প্রবীণদের দেখভাল করা আর সন্তান প্রতিপালন। পুরুষের দৃষ্টিতে এসব কাজ একেবারেই গুরুত্বহীন কেননা এর কোনো আর্থিক উপযোগিতা নেই। আর সে কারণে নারীর এসব কাজে তাদের সহযোগিতাও কম।

কিন্তু, নারী এখন উচ্চশিক্ষায় ভালো করার সাথে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজেকে শুধু দক্ষ প্রমাণ করেনি, অনেকক্ষেত্রে অনেক পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে বেশি যোগ্যতা দেখিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী৷ বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী৷ বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের শতকার ৭.৬ ভাগ নারী। উপ-সচিব পদ থেকে সচিব পদসহ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিচার বিভাগে বিচারক পদে, রাজনীতিতেও তারা অবস্থান দৃঢ়। বিমান বাহিনী, সেনা বাহিনী, নৌ-বাহিনীসহ বিমান চালনার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজেও তারা দায়িত্ব নিচ্ছে৷ সংখ্যায় মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতা, সহযোগিতার অভাবই মূল কারণ।

শরমিন্দ নিলোর্মি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের (ছেলে এবং মেয়ে) জন্য যে বিনিয়োগ থাকে তারা যেন সেটা রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দেয়। তারা সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের সেবায় যুক্ত করে। একজন ডাক্তার নারী যদি বিয়ের পর সন্তান ও সংসারের জন্য ডাক্তার পেশা বাদ দিয়ে গৃহিনী হয়ে যায় তাহলে কিন্তু সমাজ তার সেবা থেকে বঞ্চিত হলো।

কিন্তু সাংসারিক কাজের স্বীকৃতি না থাকায় এসব কাজের বিপরীতেও ব্যবস্থাগুলো তৈরি হচ্ছে না। এই স্বীকৃতি কর্মক্ষেত্রে শোভনমুলক কাজের পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে।  উদাহরণ হিসেবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন যা মেয়েদের কাজের স্বীকৃতি দেয় আবার পেশাগত কাজের উৎকর্ষতা বাড়ায়।

প্রীতি রহমানের মতো অনেককে আবার অবেতনমূলক কাজের স্বীকৃতি না থাকায় আর্থিকমূল্যের পেশায় ঢুকতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। শুধুমাত্র বিবাহিত হওয়ার কারণেও সমস্যায় পড়তে হয় অনেককে।

শাম্মী আক্তার রূপা সেরকম অবস্থার মুখোমুখি হন চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে। টিউশনি করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ মিটিয়েছেন। স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। নিজের পরিবারকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করবেন। কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তবে তার দৃঢ় মনোভাবের কারণে পরিবার তাকে আশ্বস্ত করেছিলো যে বিয়ের পরেও চাইলে চাকরি করতে পারবেন শাম্মী!

কিন্তু বেসরকারী একটি সংস্থায় চাকরির ইন্টারভিউতে শাম্মীর কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি বিবাহিত কিনা।

শুধুমাত্র বেসরকারি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান এ ধরণের সমস্যা তৈরি করছে না, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও এমনটা করে থাকে।

রাজধানীর মহাখালীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা গর্ভাবস্থায় অসুস্থবোধ করলে ছুটি চান। এতে প্রধান শিক্ষিকা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সব ক্লাস শেষ করে স্কুল ত্যাগ করতে বলেন। ফলে ওই শিক্ষিকার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে গর্ভপাত হয়ে যায়। এই ঘটনার পর ওই স্কুলেরই আরেক শিক্ষিকা গর্ভবতী হলে বিষয়টি গোপন রেখে তিনি অন্য জায়গায় বদলী হয়ে যান।

তানিয়া হক

কর্মক্ষেত্রে নারীদের এমন প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের উপায় কী? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আগামী প্রজন্মের ছেলে মেয়ে উভয়কে ঘরের কাজ শেখানোর দায়িত্ব বাবা-মা দু’জনকেই নিতে হবে। এছাড়াও বিষয়টি স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তানিয়া হক বলেন, পরিবারের জন্যই বাইরের কাজ করা। সুতরাং পরিবারকেন্দ্রিক কাজগুলো বাইরের কাজের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে বড় আকারে গবেষণা  হওয়া উচিত। আমাদের উচিত কর্মক্ষেত্রে নারীর মূলায়ন এবং গৃহস্থালির মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি পুনঃবন্টন করা।

এছাড়াও বর্তমানে যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন তাদের জন্য রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

একইরকম বললেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেন্ডার উপদেষ্টা বনশ্রী মিত্র নিয়োগী। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন,

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

যদি নারী সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণা পরিবর্তন করা না যায়, তাহলে জাতীয় উন্নয়ন ও এসডিজি লক্ষমাত্রা কখনোই অর্জিত হবে না।

‘আমাদের সমাজকে নারীর উৎপাদনমূলক ও প্রজননমূলক কাজকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। এর সাথে সংযুক্ত কাজগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে। এছাড়াও জিডিপি পরিমাপ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি মমতাজ বিলকিস বানু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অন্যান্য পেশার চাইতে সাংবাদিকতা পেশা চ্যালেঞ্জিং।

মমতাজ বিলকিস বানু

আমাদের সময় যখন কাজ করেছি তখন সব সময়ই আমরা আমাদের পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছি। তবে বর্তমান সময়েও পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বীকৃতির প্রয়োজন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, নারীর জন্য কাজের পরিবেশ সৃষ্টি ও সুযোগ বৃদ্ধিতে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ডে-কেয়ার প্রতিষ্ঠা জরুরি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেটি করণীয় তালিকায় রেখেছে। প্রতিটি অফিসে এই ব্যবস্থা নারীর অবেতনমূলক কাজেরই স্বীকৃতি।

এসডিজিকর্মজীবী নারীডে কেয়ার সেন্টারনারী