ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনে যা করতে হবে

সুর সম্রাট মান্না দে’র অসাধারণ সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; ‘সবাই তো সুখী হতে চায়; তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’ গানটি। গানের মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য স্বাভাবিক চেতনাই যথেষ্ট, বিশেষ করে গানের পঙক্তিগুলো জীবনবোধ ও ভাবাবেগের স্পষ্ট নিদর্শনের চিহ্ন প্রদর্শন করে থাকে। আমরা প্রত্যেকেই সুখানুসন্ধানের নিমিত্তে ছোট-বড় অনেক কিছুর সাথেই সম্পৃক্ত থাকি কিংবা উদ্ভাবনীমূলক কাজ কর্ম করে থাকি, পাশাপাশি পরিবার পরিজন নিয়ে বিনোদনের জন্য ভ্রমণে বের হই। এছাড়া সামাজিক উৎসব, আত্নীয়স্বজন ও পেশাজীবী বন্ধুদের সাথে আড্ডা উৎসবে মেতে উঠি একটুখানি সুখের আশায়, এমনকি অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রে যায় সুখের প্রত্যাশায়।

প্রকৃতপক্ষে সুখ প্রত্যয়টি অনুধাবনের ও অনুভূতির এবং তার বৈচিত্র্য ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্নতর হয়। যেমন: একজন কৃষক ভাল ফসল ফলানোতে সুখের ঢেঁকুর তুলতে পারে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে একজন সমাজকর্মী সমাজের যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করাতেই সুখের নিশ্বাস ফেলতে পারে। ভিন্ন ক্ষেত্রে বলা যায়; সামজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বসবাস করে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত হুমকি থেকে নিরাপদ থাকা ও পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে দিনাতিপাত করার মধ্যেও সুখ নিহিত।

ধনী-গরিব, ছোট-বড়, আধুনিক-গ্রাম্য, সৎ-অসৎ প্রত্যেকে মানুষই সুখের অনুসন্ধানে ব্যস্ত। অর্থাৎ সবাই সুখে শান্তিতে কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই বসবাস করতে চায়। আসলে কি আমরা সুখের অন্বেষণে সফল হচ্ছি? প্রতিনিয়ত আমরা যে সব সংবাদের মুখোমুখি হচ্ছি সে সংবাদগুলো কি আমাদের সুখ শান্তি সবিশেষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অবশ্যই না, কেননা পত্রিকার পাতা, টিভি নিউজের শিরোনাম, টকশোতে প্রত্যেকদিন কোন না কোন নেতিবাচক খবরের শিরোনাম আসে। এসব নেতিবাচক খবরের প্রকৃতি যে কোন মানুষকে কিংবা তার পরিবারকে সর্বত্রই অজানা আতঙ্কের মধ্যে আবিষ্ট করে রাখে।

একটা ঝঁক্কি ঝামেলা শেষ হতে না হতেই হুট করে জাতীয় পর্যায়ে নতুন করে ঝামেলার সৃষ্টি হয়ে জনজীবনে অস্বস্তি ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে থাকে। এ ধরনের গর্হিত ও অবাঞ্চিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সকল পেশা শ্রেণির মানুষ ও রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ধর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে বিগত কয়েকমাস ধরে যে ন্যাক্কারজনক ও লজ্জাজনক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে বিষয়টি স্বাভাবিক মানুষ মাত্রই তাড়না ও বেদনার সৃষ্টি করবে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ জন শিশু। যৌন হয়রানির ঘটনায় আহত হয়েছে ৪৭ জন মেয়ে শিশু ও ২ জন ছেলে শিশু।

ধর্ষণকারীরা মনুষ্যত্ববোধহীন, তাদের কোন বিচার বিশ্লেষণ নেই, নেই কোন ধর্ম। যাই হোক, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারের গ্রহণীয় ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষ সাধুবাদ জানালেও এর প্রকোপ সহসাই কমে আসছে না। ধর্ষণের পাশাপাশি আরও কিছু ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে যে বিষয়গুলো অজানা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অনুকূল। এই ধরুণ; শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া, শিশু সায়মাকে ধর্ষণ করে হত্যা, বরগুনায় রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা, পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে মর্মে গুজব ছড়ানো এ রকম অসংখ্য খবর বাংলাদেশে জনমনে আতঙ্ক ও ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রতিবাদসভা, মানববন্ধন, বিভিন্ন সভা, সেমিনার, টকশোতে আলোচনা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে, তবুও এহেন কর্মকাণ্ডের প্রকোপ কেন কমে আসছে না, এ প্রশ্নটি সবার মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার অবতারণা করছি; ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে একটি সেমিনারে দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে একজন বক্তা শিশু শ্রম বন্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করেছিলেন, বক্তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন এমন একজন জানালেন উক্ত বক্তার বাড়িতে দু’জন শিশু শ্রমিক কাজ করছে। এখন বুঝেন বিষয়টা কী? বক্তা যিনি শিশুশ্রম বন্ধে ব্যাপক তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছিলেন এবং তার বেশ কিছু প্রবন্ধ ছেপেছে পত্রিকাগুলো সেই বক্তাই যদি শিশু শ্রমিককে নিজের বাড়িতে কাজে লাগান তাহলে কিভাবে শিশুশ্রম বন্ধ হবে। অন্যান্য অপরাধ কমার বা ঘটার ক্ষেত্রে বোধোহয় এ রকমটি ঘটলে ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় অনেককেই রাস্তায় দেখা যায়, বিভিন্ন উপদেশ দিতে শোনা যায় কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু ধর্ষকের প্রশ্রয়-আশ্রয় দিয়ে থাকি। তা না হলে সারা বাংলাদেশে যেভাবে ধর্ষকের শাস্তির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়েছে সেক্ষেত্রে ধর্ষণের প্রকোপ কমে আসতো নিমিষেই। কারণ, ধর্ষকের সংখ্যা সাধারণ জনগণের তুলনায় নিতান্তই অল্প, তাদেরকে নিবৃত্ত করা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু তখনই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যখন আমরা নিজেরা গোপনে ধর্ষকদের পক্ষালম্বন করি যার ফলশ্রুতিতে ধর্ষকরা কারো না কারোর কৃপায় মামলা-হামলা থেকে বেঁচে যায়। আবার অনেকে ধর্ষণ প্রচেষ্টায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে সাহস পায় না। এ সব কারণেই মূলত ধর্ষকরা সমাজে কোন না কোন ভাবে টিকে থাকছে এবং বারংবার ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে।

ধর্ষণ কমার ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে অন্যান্য অপরাধের ভয়াবহতা ও প্রকোপ কমে আসবে সহসাই। আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ এতকিছুর পরে কেনইবা অপরাধের সংখ্যা কমে আসছে না? মূল কারণ হচ্ছে; পূর্বোক্ত বক্তার (রিপোটার্স ইউনিটির প্রোগ্রাম) মতো অনেকেই রয়েছেন যারা ধর্ষকের শাস্তির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন, প্রতিবাদ সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন এবং গোপনে গোপনে ধর্ষকসহ অন্যান্য অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। সে কারণেই ধর্ষকের মতো অপরাধীদের সমাজ থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।

বরগুনায় নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে হত্যার পর বিভিন্ন মিডিয়ায় নিউজ এসছে; নয়ন বন্ড একদিনে তৈরি হয়নি। তার পিছনের শক্তি হিসেবে প্রভাবশালী মহল কাজ করেছে, কেননা নয়ন বন্ড দীর্ঘদিন ধরে বরগুনা শহরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এসেছিলো। নয়ন বন্ড আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয় কিন্তু নয়ন বন্ডকে যারা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছেন তারা কিন্তু এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি এখনো। যদি সম্ভব হতো তাহলে সমাজে ক্রমবর্ধমানহারে চলে আসা কিংবা ঘটে আসা অপরাধগুলো ক্রমশই কমে আসতো।

যদি অপরাধের পিছনে জড়িতদের শাস্তির মুখোমুখি করা না হয় তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ কমানো কখনোই সম্ভব হবে না। কেননা অপরাধে মদদদাতারা সমাজে প্রভাবশালী এবং তারা সহজেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। একজন নয়ন বন্ডকে হত্যা করা গেলেও বা একজন নয়ন বন্ড নিঃশেষ হয়ে গেলেও আড়ালে থাকা প্রভাবশালীরা যে কোন মূহুর্তে নয়ন বন্ড তৈরি করতে পারে। সেই সব দিক বিবেচনা করে অপরাধে মদদদাতাদের সমাজ থেকে নিশ্চিহ্নে জোরালো এবং তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

কাজেই, সুখী সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো: অপরাধ মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া মানুষরূপী জানোয়ারদের মুখোশ উন্মোচন করে উপযুক্ত শাস্তি প্রয়োগ করে সমাজে তাদেরকে একঘরে করে রাখার বিধান নিশ্চিত করতে হবে। পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধী এবং অপরাধীদের মদদদাতাদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসবে এবং ফলাফল হিসেবে ধর্ষণের সংখ্যা কমে আসবে। পরিশেষে আমরা একটি সুখী সমাজের স্বপ্ন লালন করতে পারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ধর্ষণসমাজসুখ