কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ”অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।” আমাদের সময়ের স্কুলে আলাদা করে নীতিশাস্ত্র পড়ানো না হলেও, কবি গুরুর এই লাইন দুইটির উপর শিক্ষকরা সর্বচ্চো জোর দিতেন, বোধকরি এখনো দেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝলাম এই দুইটি লাইন অনুসরণ করাটাই জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার মত দরিদ্র ক্ষমতাহীন নাগরিকরা পরিষ্কার ভাবেই অন্যায় সহ্য করার সারিতে পড়ে যায়, আমরা না পারি নিজেকে ঘৃণা করতে, আবার পারিনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠে প্রতিরোধ গড়তে। ‘অন্যায়’ শব্দের অত্যন্ত ব্যাপক, অর্থাৎ যা কিছু ন্যায় বলে বিবেচিত নয়, সেটিই অন্যায়! আশাকরি আপনারা আমার সাথে একমত হবেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র দুর্নীতির বিস্তারের জন্যই আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক-কল্যানমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে যাচ্ছি।
যেকোন ধরণের দুর্নীতির মূলে দুইটি কারণ রয়েছে, একটি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া, অপরটি সামাজিক ভাবে ক্ষমতাবান হওয়া। আবার ক্ষমতার সাথে অর্থনীতির নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুষছেন। অন্যেরা মনেকরেন, দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী। তাহলে এসব দুর্নীতির দায় ভার আমরা কার কাঁধে চাপাবো ? যিনি দুর্নীতি করছেন তার কাঁধে? কিন্তু সেই ব্যক্তি তো আমাদের সমাজেরই অংশ। তাহলে সরকারের কাঁধে? সরকারতো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে! একটা দেশ যখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়, তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সরকার, জনগণ ও সমাজ কাঠামো সবার উপর কম-বেশি দুর্নীতির দায় বর্তায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি এর মত আন্তর্জাতিক সংঘঠনগুলো বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। ২০০৫ সালে জার্মানির বার্লিন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক বা করাপশন পারসেপশন্স ইনডেক্সে (সিপিআই) কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় পৃথিবীর তৎকালীন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ, একই প্রতিষ্ঠান সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি ২০২০ তাদের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৯ প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ ১৪তম, যা ২০১৮–এর তুলনায় ১ ধাপ ওপরে। বরাবরের মতো দুর্নীতির এই বৃত্রান্ত সরকারের কাছে বিব্রতকর মনে হয়েছে, এবং সরকার রুটিন মাফিক এই সূচক প্রত্যাখ্যান করেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মোট ৬টি তথ্যের ভিত্তিতে সিপিআই দুর্নীতি সূচক নির্ণয় করে। এগুলো হলো, দুর্নীতি ও ঘুষ আদান-প্রদান; স্বার্থের সংঘাত ও তহবিল অপসারণ; দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ ও অর্জনে বাধা; ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার; প্রশাসন, কর আদায়, বিচার বিভাগসহ সরকারি কাজে বিধিবহির্ভূত অর্থ আদায় এবং অনিয়ম প্রতিরোধ ও দুর্নীতি সংঘটনকারীর বিচার করতে সরকারের সামর্থ্য, সাফল্য ও ব্যর্থতা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন যাবৎ এই সূচক প্রকাশ করে যাচ্ছে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, কিন্তু আমি এই সূচকের ধাঁধা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছি না। আমরা একটু খেয়াল করলে দেখবো, এই সূচকগুলো মূলতঃ গুড গভর্নস এর কথা বলছে, যেখানে যেকোন ধরণের দুর্নীতির একটা পরিমাপক চিত্র ফুটে উঠে। প্রশ্ন হচ্ছে দুর্নীতির সব অর্থের শেষ গন্তব্য কোথায়? দুর্নীতির টাকা কড়ি নিয়ে কেউ মঙ্গল গ্রহে আস্তানা গেড়েছেন, এমন দাবী কেউ করছে না! আর সেটা যদি না হয়, তাহলে দুর্নীতির উপকারভোগী রাষ্ট্র করা?
বাংলাদেশে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত। ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, ঋণখেলাপি ও মুদ্রা পাচারের মতো বিষয়গুলো সরকারকে বারংবার বেকায়দায় ফেলছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশে টাকা পাচারে আমরা দ্বিতীয় স্থানে আছি, অর্থাৎ ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
টিআইবি ও জিএফআই এর রিপোর্ট দুইটি পাশাপাশি রাখলে একটা বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে যায়, তা হলো বাংলাদেশে আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে এবং সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য দেখাতে পারছেনা। যদিও রাষ্টের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে, এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হয়েছে, যা চলমান আছে বলেই আমরা জানি, যেহেতু সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেনি।
দুর্নীতির অর্থের শেষ গন্তব্য কোথায়? এই প্রশ্নের সমীকরণ মিলাতে হলে আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির বৈশ্বিক চেহারাটা দেখতে হবে। কারণ, এই বিশ্বব্যবস্থায় একটি দেশ একক ভাবে দুর্নীতি করে না, করতে পারে না, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির আরো অংশীদার আছে। তাই আমাদের সবার আগে দুর্নীতির বৈশ্বিক খেলাটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশে; পাচার করা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে সেখানকার কৃষি, হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্টস কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে। ব্যাংকের ঋণের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। এখন যদি সেসব দেশের সরকার হীন স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে এধরণের বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে, তাহলে প্রকারান্তরে দুর্নীতি নিরুৎসাহিত হবে। এরকম কিছু হবার সম্ভাবনা খুব কি আছে ?
ধরুন, আপনি একজন বিশিষ্ঠ মানুষ, শহরে থাকেন গ্রামে সাহায্য সহযোগিতা করেন। একদিন আপনার গ্রামের একজন পরিচিত লোক বাজার থেকে চুরি করে বেশকিছু টাকা নিয়ে আপনার শহরের বাড়িতে এলেন এবং আপনার ব্যবসায় বিনিয়োগের আগ্রহ দেখালেন। আপনি জানেন এগুলো চুরির টাকা, কিন্তু গ্রামের মানুষ আপনার ধারে কাছে ভিড়তে পারবে না, সুতারং আপনি তার প্রস্তাবে রাজি হলেন। আপনি যদি চোরকে গ্রামে ফেরত পাঠাতেন, তাহলে গ্রামবাসীর লাভ হতো, এখন লাভ হলো আপনার। মজার বিষয় হলো গ্রামের মানুষ শুধু সেই চোরকে গালি দিচ্ছে, আর আপনাকে ভালো মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় ?
দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী এরকম অদ্ভুত চিত্র আপনি খুঁজে পাবেন ! আমরা বলছি আমাদের গভর্নস সিস্টেম দুর্বল সেজন্য আমাদের দেশে দুর্নীতিপ্রণয়তা ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে, কিন্তু উন্নত দেশের উন্নত গভর্নস আমাদের মতো দেশের দুর্নীতিকে কতটা উৎসাহিত করছে, কতটা প্রভাবিত করছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে সেই তথ্য কোথায় ? আমরা জাতিসংঘের নীতিমালার কথা বলছি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এর আর্থিক ন্যায্যতার কথা বলছি, এদের কেউ একবারও বলছে না উন্নত দেশগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতির দুয়ার খোলা রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মত দেশের পক্ষে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বপ্ন থেকে যাবে।
আপনি যদি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর ২০১৯ সালের দুর্নীতির (সিপিআই) সূচক বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন, যেসব দেশ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ সেখানেই যাচ্ছে আমাদের দেশের দুর্নীতির টাকা। কিন্তু আমরা সেসব দেশের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিনা, কেবলমাত্র দুর্নীতির সুযোগ আর নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার হিসেবে নিকেশে আটকে আছি। যেসব দেশ দুর্নীতিবাজদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলে বসে আছে, আমরা তাদেরকে বলছি নীতিবান রাষ্ট্র, আর যাদের টাকা খোয়া যাচ্ছে তারা দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, যা বিশ্ব রাজনীতিতে সে সব দেশকে কোনঠাসা করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, দুর্নীতির অর্থের শেষ গন্তব্য যদি উন্নত দেশ হয়, দুর্নীতির টাকা যদি তাদের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে, তাহলে দায়িত্ব তাদেরকেও নিতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর মতো সংঘঠনগুলোর বৈশ্বিক সূচকে পরোক্ষ ভাবে দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ, দুর্নীতিকে উৎসাহিত বা প্রভাবিত করণ, দুর্নীতির অর্থ ব্যাংকে রাখার বা বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়াকে রাষ্ট্রীয় অপরাধের তালিকায় আনতে হবে, সেসব দেশকেও দুর্নীতিগ্রস্থ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এখন যদি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দাবী করে, এই বিষয়টি সেসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতির বিষয় এবং দুর্নীতির সূচকের অন্তর্ভুক্ত নয় তাহলে সেখানেই তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটবে। কারণ প্রশ্ন উঠতে পারে সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা কতটা প্রভাব মুক্ত থেকেছেন, বা বৈশ্বিক ন্যায্যতা ও সমতার নীতিনির্ধারণে ভূমিকা নিয়েছেন ? অন্যথায়, দুর্নীতির সূচকের প্রহেলিকা নিয়ে বিশ্ববাসী একদিন প্রশ্ন তুলবে, তখন কি তারা দায় এড়াতে পারবেন ?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)