দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা

ইসলাম কেবল সৎ-নীতিবান কথায় আর যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয়নি; ইসলাম প্রতিষ্ঠার পেছনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অত্যন্ত গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করেছে, যাকাত ব্যবস্থা যে অর্থনৈতিকতার প্রধান সোপান। যাকাত প্রবর্তনের সময় এবং উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য করলেই, আমাদের প্রবন্ধের শিরোনাম-অনুসারে কাঙ্খিত মনজিলে পৌঁছতে বেগ পেতে হবে না।

যাকাত প্রবর্তনের সময়
ইসলাম কখন যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করলো? যখন আরবে‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি চলছে জোরসে, যখন সমাজের ধন-সম্পদ এক পক্ষের নিকটবন্দী, যখন সমাজের উঁচু শ্রেণির সম্পদ-রোলারে অপেক্ষাকৃত নিচু শ্রেণি তথা দরিদ্র শ্রেণি পিষ্ট হচ্ছে তখনই ইসলাম ঘোষণা করলো ‘যাকাত’ ব্যবস্থার নীতি-বিধি। ইসলাম ঘোষণা করলো, ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার আছে। (সূরাআল-মাআরিজ: ২৪-২৫) আরবের দরিদ্র শ্রেণি যারা যুগ-যুগ ধরে বিত্তশালীদের দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছিলো তারা জেগে উঠলো, আশ্চর্য-সুষমায় বলে উঠলো, “ঠিকই তো!”ইসলামের এ নীতির প্রতি আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ হয়ে দলে-দলে মুসলমান হতে লাগলো তারা।

এটি একটি ঐতিহাসিক তত্ত্ব হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির ইতিহাসে প্রধান অবস্থানে আসীন। ইসলামের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠার মূলে যাকাত-ব্যবস্থার যে ঐতিহাসিক অবদান তা গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় আজও ফুরিয়ে যায়নি।

যাকাতের মূল উদ্দেশ্য
যাকাতের মূল উদ্দেশ্য নিরেটভাবে জানতে আমাদেরকে দৃষ্টি ফেলতে হবে কুরআনের সে আয়াতে, যে আয়াতে যাকাত-গ্রহণার্থে আট শ্রেণির পরিস্কার উল্লেখ খোদা তা’য়ালা করেছেন।

সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে যে আট শ্রেণির লোকদেরকে যাকাত দেওয়ার কথা এসেছে সে আটটি শ্রেণি হচ্ছে:

১. দরিদ্র (ফুকারা)
২. অভাবী (মাসাকিন)
৩. যাকাত-সংগ্রহকারী (আ’মিলিনা আলাইহা)
৪. নও-মুসলিম / ইসলামের প্রতি অনুরাগী (মুআল্লাফাতি কুলুবু-হুম)
৫. ক্রীতদাসবা গোলাম আযাদের জন্য (রিকাবি)
৬. ঋণগ্রন্থ ব্যক্তি (গারিমিনা)
৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী (ফি সাবিলিল্লাহী)
৮. মুসাফির (ওয়াবনিস্সাবিল)

এ আট শ্রেণির মধ্যে যে কোনো শ্রেণির যে কাউকে যাকাত দেওয়া যাবে; ক্রীতদাস-প্রথা এবং ধর্মযুদ্ধ বর্তমানে অনুপস্থিত থাকায় বাকি ছয়টি শ্রেণির মধ্যে যাকাত প্রদান করতে হবে।

যাকাত প্রদানের জন্য বর্তমানে চালু থাকা ছয়টি শ্রেণির মধ্যে চারটিই সরাসরি দারিদ্র্যতার সাথে জড়িত। বাকি দুইটি শ্রেণির সাথেও যে দারিদ্র্যতার সম্পর্ক নেই তা হলফ করে বলা যাবে না। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বর্তমানে জারি থাকা যাকাত-প্রদানের প্রতিটি ক্ষেত্রই দারিদ্র্যতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ থেকেই কি যাকাত-ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ‘দারিদ্র্য বিমোচন’-কে স্পষ্টাকারে চিহ্নিত করা যায় না? অবশ্যই যায়, যাচ্ছে।

আমরা বর্তমানে জারি থাকা ছয়টি শ্রেণি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করবো, ‘দারিদ্র্য বিমোচন’তথা যাকাতের প্রধান উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন কল্পে।

১. দরিদ্র (ফুকারা)
এখানে ‘ফুকারা’ শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফকির বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝে থাকি: অসহায়, অনাথ, নিঃস্ব, দ্বারে দ্বারে হাত পাতা, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকা ইত্যাদি প্রকারের লোকদের বুঝিয়ে থাকি। যারা শারীরীক ভাবে দরিদ্র তথা পঙ্গু, বিকলাঙ্গ সর্বোতভাবে যাদেরকে ‘প্রতিবন্ধী’ বলা হয় তারাও সম্পর্কিত। এখন আমাদের লক্ষ্যণীয় বিষয়, তাদেরকে কিভাবে যাকাত দিলে তাদের দারিদ্র্য দূরীভূত হবে?

এখানে একাধিক উত্তর আসতে পারে। প্রধান উত্তরটি এরকম: পরিকল্পিত বণ্টন করতে হবে। পরিকল্পিত বণ্টন বলতে, আপনার যত টাকা যাকাত আসবে তা যদি দুইটি পরিবারের মধ্যে বণ্টন করলে তাদের দারিদ্র্য দূরীভূত হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে দুইটি পরিবারের মধ্যেই বণ্টন করুন; ছয়টি পরিবারকে দিতে গেলে হয়তো কারো দারিদ্র্যই দূর হবেনা। যাকাত যেহেতু আমাদেরকে প্রতি বৎসরই প্রদান করতে হয় সেক্ষেত্রে বাৎসরিকভাবে একজনের দারিদ্র্যতা দূরীকরণে আমাদেরকে লক্ষ্য (টার্গেট)রাখতে হবে।

২. অভাবী (মিসকিন)
এখানে ‘মিসকিন’ বলতে মূলত কাদেরকে বোঝানো হয়? বুখারী শরীফের কিতাবুয যাকাত অধ্যায়ের একটি হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন: “যে অভাবের তাড়নায় দ্বারে-দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং দু’একটি খেজুর বা দু’এক গ্রাস খাবার পেয়ে ফিরে যায় সে প্রকৃত মিসকিন নয়; প্রকৃত মিসকিন ঐ ব্যাক্তি যার এমন কোনো সম্বল নেই যা তাকে অভাবমুক্ত রাখে। অথচ তার এমন দুরবস্থাও কেউ জানে না যে, তাকে কেউ কিছু দান করে এবং সেও লোকের নিকট কিছু চায় না”।

এ হাদিস পড়ে, পাঠকবৃন্দের মানসপটে নিশ্চিত রূপে ভেসে উঠেছে আমাদের সমাজের ‘মধ্যবিত্ত’পরিবারের চিত্র! হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃতপক্ষেই বলেছেন, সবচেয়ে মিসকিন আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবার তারা না পারে সইতে, না পারে কইতে। বর্তমানে করোনার ছোবলে সবচেয়ে বেহাল দশায় পতিত হয়েছে আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তাদের সাময়িক দারিদ্র্যতা দূরীকরণে আমাদের যাকাত যেন ফলপ্রসূ হয় সেভাবেই আমাদেরকে যাকাত দিতে হবে।

৩. যাকাত-সংগ্রহকারী (আ’মিলিনাআলাইহা)
কোনো সমাজে বা প্রতিষ্ঠানে যদি যাকাত একত্রিকরণের নিমিত্তে সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকে সেক্ষেত্রে ঐ অঞ্চলে যে অধিক গরিব-মিসকিন তাকে যাকাত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে গরিব/মিসকিন হিসেবে সে যাকাতেরএকাংশ প্রাপ্তির পর সংগ্রহকারী হিসেবেও একাংশের প্রাপ্য হবে।এতে তার দারিদ্র্যতা মোচন হবে খুব সহজেই।

৪. নও-মুসলিম / ইসলামের প্রতি অনুরাগী (মুআল্লাফাতি কুলুবু-হুম)
এখানে নও-মুসলিম বা ইসলামের প্রতি অনুরাগীপূর্ব-মুসলিমকে যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রেও দরিদ্রতা শর্ত একজন ইসলাম প্রীত অমুসলিমকে তখনই আপনি যাকাত দিতে পারবেন যখন সে দরিদ্র হবে। এখানেও ইসলাম একজন অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে তার দারিদ্র্যতা দূরীকরণের মাধ্যমে।

৫. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি (গারিমিনা)
ঋণে আবদ্ধ হয়ে, জর্জরিত হয়েও আমাদের সমাজে অনেককেই দারিদ্র্যের ছোবলে পরিশ্রান্ত, ক্লিষ্ট হতে দেখি। সমাজের এমন মানুষদেরকে ঋণ থেকে মুক্ত করে দারিদ্র্যের ছোবল থেকে রক্ষা করাই এ বিধানের মূল উদ্দেশ্য।

৬. মুসাফির (ওয়াবনিস্সাবিল)
মুসাফিরও এক সময় রিক্ত হয়, সে তার প্রয়োজনীয় যা কিছু নিয়ে ঘর থেকে বের হয় এক সময় তা নিঃশেষ হয়, এমতাবস্থায় পথিমধ্যে তার রিক্ততা, অসহায়ত্ব দূর করতে যাকাত দেওয়া যাবে। এখানেও আমাদের দৃষ্টিতে মুসাফিরের সাময়িক দরিদ্রতা অপরিলক্ষিত নয়।

এভাবেই যাকাত আমাদেরকে দারিদ্র্য দূরীকরণের ছবক দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। মুসলমানদের মধ্যে যারা গরিব, মিসকিন, অসহায় তাদের দুঃসময় তথা দারিদ্র্যতা দূর করে সুসময়ে, সচ্ছলতায় ফিরিয়ে আনতেই ইসলামে যাকাত-ব্যবস্থার বিধি-বিধান। দারিদ্র্য মানতবার পয়লা নম্বরের দুশমন, ক্ষেত্র বিশেষে তা কুফরির দিকে মুসলমানদেরকে নিয়ে যায়। আর সেজন্যই ইসলাম মুসলমানদের দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। যার ফলে আমরা দেখি, কুরআন শরীফে ২৭বার নামাজের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের কথা রব তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন। যেখানে ইসলাম মুসলমানদের দারিদ্র্যতা দূরীভূত করতে নিয়েছে সর্বোত্তম ব্যবস্থা সেখানে যাকাত-ই ইসলামের প্রধান হাতিয়ার।

যাকাতরমজান