একবার দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এত মেয়ে থাকতে আপনি সিনেমাতে আমাকে নিলেন কেন? উত্তরে দাদা (সুভাষ দত্ত) বলেছিলেন, “তোমার নতুন দাঁত উঠেছিল তো, তাতে তোমার হাসিটা চমৎকার ছিল। ওই ঢেউ খেলানো দাঁতের হাসির জন্যই তোমাকে নিয়েছি”।
আর সেই ঢেউ খেলানো হাসি, মিষ্টি হাসিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর সেই মেয়েটির নামের আগে যুক্ত হয় ‘মিষ্টি মেয়ে’র খেতাব!
বলছি সদ্য প্রয়াত দেশের কিংবদন্তী অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীর কথা। ‘মিষ্টি মেয়ে’ ছাড়াও দর্শকমহলের বিরাট অংশের কাছে তিনি ‘সখী’ হিসেবেও পরিচিত।
বাংলা চলচ্চিত্রে সুভাষ দত্তের হাত ধরে তিনি এসেছিলেন। সুভাষ দত্ত তার ‘সুতরাং’ ছবির জরিনা চরিত্রের জন্য একটি মেয়ে খুঁজছিলেন। এমন একটি মেয়ে, যিনি নায়িকা হবেন স্বয়ং সুভাষ দত্তেরই বিপরীতে। ছবির সংগীত পরিচালক সত্য সাহার সাথে ছবির নায়িকা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। বললেন, মেয়েটিকে হতে হবে ছোটখাটো, কমবয়সী। দেখলেই যেন দেখতে ইচ্ছে করে। সত্য সাহা চট করে কবরীর সন্ধান দিলেন। সত্য সাহা বললেন, চট্টগ্রামে একটি মেয়ে আছে, নাম মিনা পাল। তুমি যেমন চাইছো, তার অনেকখানিই মেয়েটির সাথে মিলে যায়। মেয়েটি মঞ্চে কাজ করে, নাচের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। চাইলে একবার দেখতে পারো।
সত্য সাহার কথা শুনে সুভাষ দত্ত বিমানে করে চট্টগ্রামে সত্য সাহাকে সাথে নিয়েই রওনা হলেন। চট্টগ্রামের ডা. কামালের সঙ্গে কবরীর বাবার সখ্যতা ছিল। সে কারণেই তিনি ডা. কামালকে সাথে নিয়ে কবরীদের বাড়িতে গেলেন। দুঃখের বিষয় সেদিন বাড়িতে ছিলেন না কবরী। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহে। কবরীর দেখা না পেয়ে তারা ফিরে এলেন ঢাকায়। পরে কবরী ফিরলে তার বাবা সত্য সাহাকে খবর দেন। সুভাষ দত্ত ড. কামালকে বললেন, কবরীর কিছু ছবি তুলে নিয়ে আসার জন্য। এরপর ঢাকা থেকে সুভাষ দত্ত খবর পাঠালেন যে, কবরীর তোলা ছবিগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর হাসি নাকি সুভাষের কাছে অসম্ভব সুন্দর মনে হয়েছে। কবরীকে ঢাকায় আসার জন্য বলা হলো।
সাথে সাথে কবরী ঢাকায় এসে উঠলেন পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে। এরপর সুভাষ দত্তের সামনে এসে দাঁড়ালেন কমলা রঙের ফ্রক পরে। দাদা বললেন, ‘যাও তো শাড়ি পরে আসো। ‘শাড়ি পরে আসলেন। তারপর ভয়েস টেস্ট করা হল’। দাদা বললেন, সবই ঠিক আছে, কিন্তু কথার মধ্যে তো চাটগাঁয়ের আঞ্চলিক টান আছে। সকল জল্পনাকল্পনা শেষে সুতরাং এর জরিনা চরিত্রের জন্য কবরীকে নির্বাচন করা হল।
পরবর্তীতে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে একটি বেসরকারি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, “দাদা আমাকে যেভাবে সংলাপ বলতে বলেছিলেন, আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে সেভাবেই সংলাপ আওড়াতে থাকলাম। দাদা সৈয়দ শামসুল হক আমার নাম দিয়েছিলেন ‘কবরী’। আর ‘মিনা পাল’ থেকে আমি হয়ে গেলাম চলচ্চিত্রের নায়িকা “কবরী”।
‘সুতরাং’ সিনেমাটির শুটিংয়ের পরেই কবরীর বিয়ে হয়ে যায় চিত্ত চৌধুরীর সাথে। পরিবারের অসচ্ছলতা, আর্থিক অনটনের কারণে পরিবারের কথায় বাধ্য হয়েই তিনি বিয়ে করেছিলেন। পরে, ১৯৬৪ সালে “সুতরাং” সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে আসার পর কবরীকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার একবছর পর চিত্ত চৌধুরীর সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। মাত্র ১৩–১৪ বছর বয়সে কবরী হয়ে ওঠেন মেগা স্টার। সেই বয়সেই “সুতরাং” ছবিতে অভিনয় করে তিনি পাকিস্তানি-ভারতীয়-হলিউডি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জয় করেছিলেন দর্শক–হৃদয়। ছবিটি হয়েছিল সুপার–ডুপার হিট। ১ লাখের কিছু বেশি টাকা বাজেটের এই ছবি তখন আয় করেছিল ১০ লাখ টাকা। আর ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পেয়েছিল দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার। বিলেতের রাজা-রানি সেই ছবিতে কবরীর অভিনয় দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমা, সুতরাং (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), সোয়ে নদীয়া জাগে পানি (১৯৬৭), সাত ভাই চম্পা (১৯৬৭), আবির্ভাব (১৯৬৭), বাঁশরি (১৯৬৮), ময়নামতি (১৯৬৮), নীল আকাশের নীচে (১৯৬৯), কখগঘঙ (১৯৬৯), দর্পচূর্ণ (১৯৬৯), বিনিময় (১৯৬৯), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), জলছবি (১৯৭১) রংবাজ (১৯৭৩), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), সুজন সখী (১৯৭৫), সারেং বউ (১৯৭৮), বধূ বিদায় (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৮২), এ অভিনয় করেছিলেন।
প্রয়াত নায়ক রাজ রাজ্জাকের সাথে ১৯৬৮ সালে প্রথম অভিনয় শুরু করেন কবরী। নায়ক রাজ্জাক একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কবরীর সঙ্গে তাঁর জুটি গড়ে উঠেছিল “ময়নামতি” সিনেমা দিয়ে। এটি ছিল একটি রোমান্টিক সিনেমা।
রাজ্জাক বেঁচে থাকা অবস্থায় একটি অনুষ্ঠানে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কবরীর সাথে আপনার জুটি ওপার বাংলার উত্তম-সুচিত্রার মতোই জনপ্রিয়, আপনাদের মধ্যে প্রেম ছিল কিনা। উত্তরে নায়ক রাজ্জাক বলেছিলেন, না থাকলে কি আর এই জুটি গড়ে ওঠে, কবরীর সাথে প্রেমটাকে তিনি স্বীকার করেছিলেন।
২০১৮ সালে “সেন্স অফ হিউমার” অনুষ্ঠানে কবরী এসেছিলেন। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, নায়ক রাজ্জাকের সাথে আপনার প্রেম ছিল কিনা? উত্তরে তিনি স্বীকার করেছিলেন, ছিল। প্রেম ছিল বলেই রাজ্জাক-কবরী জুটি এখনও সবার মুখে। তিনি এই শোতে বলেছিলেন, আমি রাজ্জাক বিশ (২০) বছর একসাথে সিনেমা করিনি। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে আমরা ফান্ড সংগ্রহ করার জন্য ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম। সেখানে রাজ্জাক আমার সাথে দুষ্টুমির ছলে কিছু কথা বলেছিল। যেই কথাগুলো আমার সম্মানে লেগেছিল। পরে দুজনে এই কথা, সেই কথা শুরু হয়। ওখানে আরও অনেকেই ছিলেন, কিন্তু কেউ আমাদের ঝগড়া থামাতে আসেননি। এক পর্যায়ে রাজ্জাক আমাকে রেখেই পুরো টিমসহ ঢাকায় চলে আসে। সেইসময় সেখানে শাবানার স্বামী সাদিক সাহেব আমাকে সাথে নিয়ে ঢাকা ফিরেছিলেন। তারপর থেকে আমাদের একসাথে সিনেমা করা হয়নি। আর এই সুযোগে অনেক নায়িকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। আমাদের জুটি ভাঙ্গার জন্য অনেকেই অনেক ধরনের রাজনীতি করেছিল সে সময়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে একবার কবরী বলেছিলেন, ‘সেখানকার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলাম। কীভাবে আমি মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে সেখানে পৌঁছেছি, সে কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করি।’ কলকাতায় থাকাকালে আর্থিক ও অন্যান্য কারণে সিনেমায় সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা হয়নি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উত্তমকুমারসহ অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর।
কবরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সেইসময় উত্তম কুমার আমাকে বলেছিলেন, কবরীদেবী আপনাকে নিয়ে সিনেমা করতে চাই কিন্তু আপনার যা বাজেট, আমার তো সেই টাকা নেই। আমি বলেছিলাম, আমাকে কোন টাকা দিতে হবে না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমরা একসাথে সিনেমা করবো। কিন্তু পরে আর সিনেমা করা হয়নি। পরে অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের সাথে “তিতাস একটি নদীর নাম” সিনেমাটি করেছিলাম।
কবরী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন তিনি। রাজনীতিতে জড়িয়ে সাংসদও হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ–৪ আসনের দায়িত্ব তুলে দেন তার হাতে। সেখানে তিনি নির্বাচিত হন জনপ্রতিনিধি হিসেবে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সেখানকার মানুষের জন্য নানা রকম কাজ করে গেছেন।
২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এমনকি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। তিনি যুক্ত ছিলেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
কবরী তার “আয়না” সিনেমাতে নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন সোহানা সাবাকে। তিনি ছিলেন নবাগতা। তার কাছে জানতে চেয়েছি কবরী সম্পর্কে। কবরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই অঝোরে কেঁদে ফেললেন সাবা। বললেন, কোনোভাবেই আমি মানতে পারছি না যে কবরী আপু আর নেই। আমার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালে। তাকে ফোন করে বলেছিলাম, আপু দুপুরে আপনার বাসায় খাবো। তারপর তার বাসায় গিয়েছিলাম এবং দুপুরে একসাথে খেয়েছিলাম। সেইসময় বলেছিলাম, আপু আসেন একটা সেলফি তুলি। কবরী আপু বললেন, তোমার আমার কারোরই চেহেরা ভালো দেখাচ্ছে না। এরপর করোনার মধ্যে উনার অসুস্থতার কথা শুনে ফোন করি। বললাম, আমি আসি আপু। উনি সাথে সাথেই নিষেধ করলেন।
সাবা বলেন, অনেকেই হইত জানেনা যে, কবরী আপু এত ভালো রান্না করতেন এবং অন্যকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। কোন তরকারীতে কি মসলা দিতে হয় একবার সেটাও শেখালেন। আয়না সিনেমাতে আমাকে না নিলে আমি নায়িকা সোহানা সাবা কখনও হতাম না। আমাকে উনি পুণর্জন্ম দিয়েছেন। আয়না সিনেমাতে কবরী আপু নিজের হাতে সবকিছু করেছেন। মেকআপ থেকে শুরু করে ড্রেস সবকিছু। এমনকি মাঝে মাঝে উনি কীভাবে অভিনয় করব তার খুঁটিনাটি সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছেন। একবার তো উনি নেচেই দেখালেন আমাকে। আর আমি তাকে কপি করলাম। একটা ব্যাপার অনেকেই জানেন না যে, কবরী আপুর প্রথম ছবি আয়নাতে সুভাষ দত্ত আমার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং কবরী আপুর প্রথম সিনেমা ছিল ‘সুতরাং’। সেখানে তিনি একটি গান করেছিলেন, “তুমি আসবে বলে, ভালোবাসবে বলে”- সেই গানটি পরবর্তীতে সংগীত পরিচালক ইমন সাহা আয়না সিনেমাতে রিমিক্স করেছিলেন। কবরী আপুর সাথে এই জীবনে যত গল্প হয়েছে, যতকিছু শিখেছি সেটা মেনে এখনও চলি। আমার ভেতরে উনার ছায়া আছে। একবার উনি হেসে হেসে বলেছিলেন, ‘ছেলেদের কোনদিন বিশ্বাস করবি না’।
কেন বিশ্বাস করতে মানা করেছিলেন, সেটা মতিউর রহমানের সাক্ষাৎকার পড়লে বোঝা যায়। বরেণ্য এই অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী দুই বছর আগে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এর সাথে এক সাক্ষাৎকারের শুরুতেই চমকে দিয়ে বলেছিলেন, “আমার একটা দুঃখ রয়ে গেলো, জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না, ভালো স্বামী পেলাম না। সন্তানেরা অনেকটা যার যার মতো করে আছে। কিন্তু সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি”।
মতিউর রহমান জানতে চেয়েছিলেন আপনার সাথে অনেকের অনেক ভালো সম্পর্ক, কেউ কখনো বিয়ে করতে চায়নি? উত্তরে কবরী বলেছিলেন, “সবাই ভাল সম্পর্ক রেখেছে, দেখলে জড়িয়ে ধরেছে, চুমু খেয়েছে কিন্তু বিয়ে কেউ কখনোই করতে চাইনি”।
এই মহানায়িকার জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। তাঁর আসল নাম মিনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও সবশেষে সিনেমায়। কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা।
বনানী কবরস্থানে কবরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ছবিঃ সংগৃহীত
৭১ বছর বয়সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশ বরেণ্য এই মিষ্টি মেয়ে গত শনিবার ১৭ এপ্রিল রাত ১২টা ২০ মিনিটে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
এত বড় মাপের একজন বরেণ্য অভিনেত্রীর শেষযাত্রায় পরিবারের পক্ষ থেকে ছিলেন তার একমাত্র ছেলে। চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে কাছের কাউকে দেখা না গেলেও বনানী কবরস্থানে ছুটে এসেছিলেন ‘আয়না’ ছবির নায়িকা সোহানা সাবা, শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানসহ দু-একজন পরিচালক।
কবরীর (১৯৫০-২০২১) চলে যাওয়া মানে অনেক কিছুই চলে যাওয়া। তিনি ছিলেন ইতিহাসেরও অংশ। চলচ্চিত্র, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজকল্যাণ, সাংস্কৃতিক সংগঠক-কত কিছুর সঙ্গেই না তিনি জড়িত ছিলেন। কবরী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবদান রেখেছেন। পাশাপাশি তিনি ৫৮ বছরের চলচ্চিত্রজীবনের একজন সফল অভিনেত্রী, সফল পরিচালক ও দেশে-বিদেশে নন্দিত। অথচ তার রাষ্ট্রীয় পদকের ঝুলিতে তাকালে হতাশ হতে হয়!
স্বীকৃতিস্বরূপ কবরী পেয়েছেন, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার হিসেবে “বাচসাস এ্যাওয়ার্ড” লালন ফকির (১৯৭৩), সুজনসখী (১৯৭৫), সারেং বউ (১৯৭৮), দুইজীবন (১৯৮৮), সম্মাননা পুরস্কার (২০০৮), আজীবন সম্মাননা (২০০৯),। এছাড়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে ১৯৭৮ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী “সারেং বউ” ২০১৩ সালে আজীবন সম্মাননা এবং সবশেষ ২০১৬ সালে “মেরিল প্রথম আলো” চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের একলাখ টাকার মধ্যে ৫০হাজার টাকা প্রতিবন্ধী ও ৫০হাজার টাকা অটিস্টিক বাচ্চাদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন, যেন তারা একটু ভালো খাবার খেতে পারে।
দর্শকের ভালবাসায় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা ‘কবরী রোড’কে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেয়। চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি রাস্তার নাম “কবরী রোড”। ৪৭ বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছিল এই নামটি। মূলত,‘কখগঘঙ’ সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সারাহ বেগম কবরী ও রাজ্জাক। চুয়াডাঙ্গাতে “কখগঘঙ” সিনেমার শুটিং হয়, তখন কবরী খুব জনপ্রিয় ছিলেন। সবাই দেখতে আসত। এসে বলত, কবরী কোথায় থাকে? লোকজন দেখিয়ে দিত, ওই যে ওই বাড়িতে। রিকশাওয়ালারা উৎসুক লোকজনকে নিয়ে আসত। শুটিংয়ের এক মাসে মুখে মুখে কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়ে কবরী রোড নামটি। যে বাড়িতে ‘কখগঘঙ’ সিনেমার শুটিং হয়েছে, বর্তমানে তার মালিক সপরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বাড়ির একটি অংশে ব্যবসায়ী আখের আলী স্ত্রী, দুই সন্তানসহ বসবাস করেন। অপর অংশে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেস করে থাকেন। চুয়াডাঙ্গা শহরে এটি ‘কবরী মেস’ নামে পরিচিত।
অভিনেত্রী কবরী সবসময় বলতেন, সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে, ভাবলেই ভয় হয়। তাই মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যত দিন বাঁচব, মানুষের কাছে আপন হয়ে থাকতে চাই, মানুষের কাছাকাছি থাকতে চাই।’ তিনি থেকেছেন। যেসব কাজ তাঁকে ভুলতে দেবে না, সেসবই করে গেছেন। তাঁর ঢেউ খেলানো দাঁতের হাসি সবার মনেই থেকে যাবে আজীবন। গভীর শ্রদ্ধা এই বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)