বিগত অনেক বছর ধরেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটি বহুল আলোচিত বিষয়বস্তু। যেটা নিয়ে পৃথিবীর অনেক গবেষক, স্কলার, সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রীরা বহু গবেষণা, আলোচনা, সেমিনার করে আসছে। এনিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, হলিউডসহ পৃথিবীর বাঘা বাঘা অভিনেতা/অভিনেত্রী ঐসব ছবিতে অভিনয় করেছে l
সবার একটি সাধারণ ধারণা ছিল- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিযোগিতা আর যার ফলে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই যুদ্ধের কল্পিত একটা রূপ চিত্রায়িত হয়েছে।
কিন্তু সত্যিকারের ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শুরু হলো অদৃশ্য, পরাক্রমশালী, দৈত্যরূপে আবির্ভূত করোনাভাইরাস (কোভিড -১৯) এর বিরুদ্ধে। যার সাদৃশ্য দেখা যায় হাজার হাজার বছরের পুরানো গ্রিক মিথোলজি, এরাবিয়ান মিথোলজি, এমন কি ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টের অনেক পৌরাণিক কাহিনীতেও।
সেগুলোকে এতদিন আমরা মিথ হিসাবেই দেখে আসছি,
আর বর্তমান বিজ্ঞানের প্রসারে আমরা যখন আমাদের জীবন প্রত্যাশা (life expectancy ) প্রায় ১০০ বছর এ নিয়ে গেছি, ঔষধ শিল্পের প্রভূত গবেষণায় বেশিরভাগ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করছি, আমরা যখন বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক যুদ্ধের কথাই শুধু ভাবছি, প্রায় ভুলতেই বসেছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা- ঠিক তখনি শুরু হয়ে গেলো অদৃশ্য দৈত্যের তাণ্ডবলীলা।
করোনাভাইরাস যুদ্ধ ঘোষণা করলো মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে, মানবজাতির বিরুদ্ধে, তছনছ করে দিচ্ছে বর্তমান সভ্যতা – যে যুদ্ধের শুরু হয় ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে জাপান, সাউথ কোরিয়াসহ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশে, আর তারপরে কোনই সীমানা থাকলো না যেন, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়িয়ে আফ্রিকা মহাদেশ এনং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পৃথিবী নামক এই গ্রহের আনাচে কানাচে!
যুদ্ধ শুরুর তিন মাসের মাথায় আজ সারাবিশ্বে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত, মৃতের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজারের ঘরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ষাট থেকে সত্তর হাজারের মতো নতুন আক্রান্ত হচ্ছে, আর মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জার্মানির নেতৃত্বে হাঙ্গেরি অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যসহ কিছু দেশ এক পক্ষে আর ব্রিটেনের নেতৃত্বে ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া, জাপান, আমেরিকাসহ ইউরোপের আরো দেশ। ১৯১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে এই যুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালে। যে যুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বে দেশগুলো পরাজয় বরণ করে, ব্রিটেনের নেতৃত্বে জোট জয় লাভ করে। প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরো বিস্তার লাভ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। এক পক্ষে জার্মানি, ইতালি এবং জাপান আর অন্য পক্ষে বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকাসহ বাকি বিশ্ব। এই যুদ্ধ ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। আবারো জার্মানির নেতৃত্ব পরাজিত হয়, গ্রেট ব্রিটেন এর নেতৃত্ব জয় লাভ করে। কিন্তু প্রায় ৫ কোটি মানুষ এই যুদ্ধে জীবন দেয়।
সুতরাং যুদ্ধ মানেই মানবিক বিপর্যয় এবং সেখানে জয় পরাজয় থাকবেই। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল দেশে দেশে যুদ্ধ, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধ।
কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না, তবে যত লম্বা সময় নিবে তত মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা আকাশচুম্বি হতে থাকবে। এর পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির চরম বিপর্যয় ঘটবে, মানুষ বেকার থাকবে মানে কোনো আয় থাকবে না, খাদ্য ঘাটতি ঘটতে পারে, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটতে পারে।
মানুষ তার মেধা দিয়ে একদিন ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ জয় করবে। অবশ্যই মানুষের মেধার স্বাক্ষর হিসাবে করোনাভাইরাস এর ঔষধ বের হবে। আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ অনেক দেশ মেডিসিন বের করতে যাচ্ছে, হয়তো আগামী বছরের শুরুতে এই ঔষধ বাজারজাত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আগামী সাত/মাস এই যুদ্ধের যে ডামাডোল থাকবে, তাতে মানবিক বিপর্যয় কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল।
এখন এই মুহূর্তে উপরআলার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে বলে মনে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)