তুষার কারামুক্ত হলো, সুস্মিতার প্রেম প্রাণ পেলো

যে হৃদয় নিংড়ানো প্রেমের পর ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হরিজন বর্ণের ছেলে তুষারকে বিয়ে করেছিল সুম্মিতা, সেই প্রথা ভাঙা প্রেম আজ প্রাণ ফিরে পেলো।

ভালবাসার অপরাধে ‘অপরাধী’ প্রেমিক তুষার অবশেষে বৃহস্পতিবার কারামুক্ত হলো। বর্ণ প্রথাকে দূরে ঠেলে ভয় কে জয় করা তুষার-সুস্মিতার অনবদ্য প্রেমের শুরু কয়েক বছর আগে। অত:পর ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর শরীয়তপুরের ছেলে তুষার দাসকে বিয়ে করে একই এলাকার মেয়ে সুম্মিতা দেবনাথ অদিতি। কিন্তু শুরু থেকেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সুস্মিতার পরিবার।

এরপর সুস্মিতার মা ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবরে তুষারের বিরুদ্ধে তার মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন। এই মামলার প্রেক্ষাপটে সুস্মিতাকে থাকতে হয় সেফহোমে, আর তুষারকে যেতে হয় কারাগারে। বয়সের বিচারে পরবর্তীতে সুম্মিতা মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পর শরিয়তপুরের কিশোর আদালত তুষারকে জামিন এবং সুম্মিতা সেফহোম থেকে নিজ জিম্মায় দেন। আর মামলাটি শরিয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

অন্যদিকে কিশোর আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে সুম্মিতার মা। অন্যদিকে মামলার কার্যক্রম চলতে থাকে শরিয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। একপর্যায়ে নারী ও শিশু আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু সুস্মিতার মায়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিশোর আদালতের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট।

যার ফলে তুষারকে জামিন এবং সুম্মিতাকে সেফহোম থেকে নিজ জিম্মায় দেওয়ার আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে তুষারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন করে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত তো এই মামলা খারিজ করে দিয়েছেন।

তখন হাইকোর্ট আবার তুষারকে জামিন এবং সুস্মিতাকে নিজ জিম্মায় থাকার আদেশ দেন। সেই সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতকে সুম্মিতার বয়স নির্ধারণ করে হাইকোর্টকে জানাতে আদেশ দেন।  তবে শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা জজ আ. ছালাম খান মাত্র ১ দিনেই এই মামলায় আসামীর জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে রায় ঘোষণা করেন।

সেই রায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপরই তুষারকে নেওয়া হয় কারাগারে। পরবর্তীকালে এই সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন তুষার। এরপর থেকেই স্বামীকে কারামুক্ত করতে তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে হাইকোর্টে ঘুরতে থাকে সুম্মিতা।

গত ১ আগস্ট বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তুষারকে জামিন দেন এবং তার অর্থদণ্ড স্থগিত করেন।

এসময় হাইকোর্ট বলেন: ‘বিষয়টি এমন যে, এক দিকে আইন আর এক দিকে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা।  যদিও আইনে উঁচু -নিচু বর্ণে বিয়েতে কোন বাধা নেই। কিন্তু মেয়ের পরিবারের সামাজিক বাস্তবতাটাও ভাবতে হয়। কারণ, আমাদের সমাজে অনেক সময় এরকম ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারকে একঘরে করা হয়।’ এদিন আদালতে তুষারের পক্ষে লড়েন আইনজীবী শিশির মনির ও মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসাইন।

হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশের পর বুধবার দুপুরে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান তুষার।  স্বামীর মুক্তির পর খুশিতে উচ্ছ্বসিত সুম্মিতা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমি ভালবেসে সেচ্ছায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে তুষারকে বিয়ে করেছি। আমাদের কোল জুড়ে একটি সন্তান এসেছে। তুষার কারাগারে থাকায় আমি আমার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন আমি চিন্তামুক্ত। ওর বাবা এখন কারামুক্ত।’

ছেলের মুক্তির পর বাবা রঞ্জিত দাস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমার ছেলে মুক্তি পাওয়ায় আজ আমি খুব খুশি। সুস্মিতা আমার মেয়ের মত হয়েই আমাদের ঘরে আছে। এখন ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে একসাথে ভালই থাকবে।’

তুষারসুস্মিতাহাইকোর্ট