তামিম ইকবালের একটু সমালোচনা করব আজ! ক্রিকেটার তামিমের সমালোচনা করার তেমন কিছু নেই, তবু তার লাইভ শো নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। তামিম ইকবাল বাংলাদেশি বাঙালি। জন্ম এবং মাতৃভাষা সূত্রে আমিও তাই। তবে পার্থক্য হলো- তামিম একজন মহাতারকা। আর আমি সাধারণ মানুষ। তার একজন ভক্ত হিসেবেও আমার অধিকার আছে তাকে কিছু বলার। অধিকার যদি নাও থাকে, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব হিসেবে আমি কিছু কথা বলবই তামিম ইকবালকে।
তামিম ইকবালের ভক্তরা এই লেখা কেমনভাবে নেবেন আমি জানি না। আমি নিজেও তো তামিম ইকবালের ভক্ত। এমন লড়াকু, ড্যাশিং এবং দেশপ্রেমিক এক স্পোর্টসম্যানকে ভালো না বেসে উপায় আছে? তামিম ভাঙা হাত নিয়েও যেভাবে ব্যাট করে যাওয়ার সাহস দেখান সেটি ক্রিকেট ইতিহাসেরই বিরল ঘটনা। তামিম বাংলাদেশের মানুষকে যতবার আনন্দ আর গৌরবের অনুভূতি দিয়েছেন তাতে তামিম ইকবালকে লাখো কোটি সালাম। আমি আসলে ভারতের ক্রিকেটার ভিরাট কোলির সাথে তামিম ইকবালের লাইভ শো নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আসলে লাইভ শো নিয়েও না। বাংলাদেশি ক্রিকেটারের লাইভ শোতে ভিরাট কোলির লাগাতার হিন্দি বলা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। যদিও ভিরাট কোলির এতে আমি কোনো দোষ দেখি না। কারণ তিনি তো ইংরেজিতেই শুরু করেছিলেন। তামিমই আকস্মিকভাবে হিন্দিতে প্রশ্ন করে বসলেন। হিন্দি বলা কি অপরাধ? মোটেও না। আমি নিজেও হিন্দি পারি, হিন্দি বলিও জায়গামত। ভারতে গেলেও একেবারেই দরকার না হলে আমি বলি না। আর ভারতেও সবাই হিন্দি বলে না। বরং কেরালা, তামিলনাডুর অঞ্চলে হিন্দি বলা রীতিমত প্রতিহত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন থামাতে সচেতন বাঙালিরা যথেষ্ট তৎপর।
পাকিস্তান আমলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি যতখানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। যারা শহীদের সংখ্যা কম বলে মনে শান্তি পান এরা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, ক্র্যাকপ্লাটুন আর মুক্তিকামী কোটি কোটি মানুষ একরোখা আর একজোট ছিল বলেই পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীও পরাজিত হয়েছিল। ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনারাও সরাসরি যোগ দেয় এবং অনেকে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেন। তবে মুক্তিযোদ্ধারা আগেই বিজয়ের প্লাটফর্ম প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। যদিও ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা, ইতিহাসবিদেরা ১৯৭১ এর আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে প্রায়শই তৎপর হন। ৭১কে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনীসহ অন্যান্য সকল মুক্তিযোদ্ধা, ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ সম্ভ্রমহানী সব কিছুকে তুচ্ছ করা হয়। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের যে কোনো প্রসঙ্গে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু আর সকল মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
অনেকে বলেন ক্রিকেটের সাথে আবার মুক্তিযুদ্ধ বা ইতিহাসের কী সম্পর্ক? বাংলাদেশে ক্রিকেটের সাথে এখন সবকিছুর সম্পর্ক আছে। এই ক্রিকেটাররাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে সারা বিশ্বে একটা সম্মানজনক পরিচিতি এনে দিয়েছেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ক্রিকেট বলতে বাংলাদেশ ছিল দুইভাগে বিভক্ত; ভারত আর পাকিস্তান। নিজের দেশ যখন বিশ্ব পর্যায়ে খেলে না, তখন মানুষের আর কীইবা করার ছিল। আমাদের পরিবারের সবাই ছিল ভারতের সাপোর্টার। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট টিম মানে ভারত। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনও একই অবস্থা ছিল আমার। কলেজের নর্থ হোস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের কথা খুব মনে পড়ছে এখন। ওয়ানডে হোক আর টেস্টই হোক, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই টিভিরুম দুই শিবিরে ভাগ। পাকিস্তানের সাপোর্ট বেশি ছিল, ভারতের কম। ফলে আমাদের গলা ফাটাতে হত বেশি। তখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলত। তখন আমাদের স্থানীয় স্টার ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, হাসিবুল হোসেন শান্ত, আকরাম খান ও গোলাম নওশের প্রিন্স। এখনো আমার কাছে বাংলাদেশের সেরা পেসার গোলাম নওশের প্রিন্স। কোনো পরিসংখ্যান দিয়ে আমি এটা প্রমাণ করতে পারব না। কিন্তু দীর্ঘদেহী বামহাতি বোলার প্রিন্সকে যখন বিটিভির পর্দায় দেখতাম তখন মনের মধ্যে একটা ভাব আসত। আমার এই মূল্যায়ন ক্রিকেটীয় নয় হয়ত।
অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মত ক্রিকেটও আজ করোনার কারণে স্তব্ধ। এই মন উদাস করা পরিস্থিতিতে অন্য এক আমেজ নিয়ে এসে সবাইকে দারুণ ভালোলাগার মুহূর্ত উপহার দিতে শুরু করেছেন তামিম ইকবাল। আমার চোখে সবচেয়ে স্মার্ট বাঙালি ক্রিকেটার তিনি। আমি বলছি স্মার্ট, আমি বলিনি সেরা। আমার কাছে তাই মনে হয়। সেরা বাঙালি ক্রিকেটারের তালিকার শীর্ষস্থানে অবশ্যই মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা কিংবা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বসবেন। তামিম যেভাবে লাইভ করছেন তাতে তার স্মার্টনেস নতুন করে প্রমাণিত হচ্ছে। বিশেষ করে নানা দেশের ক্রিকেটারদের সাথে যেভাবে তিনি কথা বলেন সেটি অবশ্যই স্যালুট পাওয়ার যোগ্য। পারিবারিক কারণে তামিম ইকবালের ইংরেজি গড়পড়তা বাংলাদেশীর চেয়ে অনেক ভালো।
যাই হোক, হিন্দি ভাষার বিষয়ে আসি। যাওয়ার আগে নিজের জীবনের এক গল্প বলতে চাই। এক সরকারি সফরে ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে যাচ্ছি। সিঙ্গাপুরের ছেঙ্গি বিমানবন্দর থেকে পার্থের দিকে যাত্রা শুরু হবে। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা যে বাংলাদেশের এটা আশপাশের সবাই বুঝতে পারছে। কারণ বাংলাতে কথা বলছিলাম আমরা। এর মধ্যে ভারতের এক শিখ ভদ্রলোক আমাদের সাথে সরাসরি হিন্দিতে কথা বলতে চাইলেন। মুরুব্বী মানুষ। আমার সাথের একজন খুব গদগদ হয়ে হিন্দিতে উত্তর দিতে চাইলেন। আমি শক্ত করে উনার হাত ধরলাম। আর ঐ ভারতীয় ভদ্রলোককে ইংরেজিতে বললাম যে, ‘আমরা হিন্দি বুঝি না, ইংরেজিতে কথা বললে সুবিধা হয়’। ভারতের মানুষ আমাদের থেকে ইংরেজিতে ভালো। দেখতে শুনতে দারুণ সেই ভারতীয় নাগরিক ইংরেজি পারবেন না, এটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না। ভারতীয় শিখ ভদ্রলোক আমার মনোভাব বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালেন না।
ভারতের হিন্দিভাষী অনেকে মনে করেন বাংলাদেশে চাইলেই হিন্দি বলা যায়। এই মনে করার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের প্রভাব আছে, একটা আধিপত্যবাদী প্রবণতা আছে। একজন হিন্দিভাষী ভারতীয় নাগরিকের কেন আগে থেকেই মাইন্ডসেট থাকবে যে, বাংলাদেশের মানুষ হিন্দি পারবেই? যাই হোক, সেদিন ভিরাট কোলি কিন্তু আগে হিন্দি বলেননি। তিনি ইংরেজিতে বলছিলেন। তামিম ইকবালই হিন্দি শুরু করেছিলেন। এটা তামিম ইকবাল ইচ্ছে করে করেছেন সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। হয়ত মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। ভিরাট কোলির মত স্মার্ট ক্রিকেটার এই সুযোগ কেন হাতছাড়া করবেন? লাখ লাখ বাঙালির সামনে তিনি ক্রমাগত হিন্দি বলে গেছেন। অসচেতন বাঙালি বুঝে হোক না বুঝে হোক বাহবা দিয়ে গেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)