ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) হতে যাওয়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শেষ সময়ের প্রচারণায় মুখরিত পুরো মহানগর। আগের নির্বাচনগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রার্থীরা গণসংযোগ করলেও এখন তা পাল্টে গেছে। সেই জায়গায় এসেছে প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণা। যে কারণে পাল্টে গেছে প্রচারণার ধরন-কৌশল।
প্রার্থীদের মূল হাতিয়ার এখন অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ডিজিটাল প্রচারণা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুগের চাহিদায় প্রযুক্তিকে লুফে নিচ্ছে প্রার্থীরা। তবে প্রার্থীরা শুধুমাত্র প্রযুক্তি নির্ভরতা দিয়ে গণমানুষের কাছে পৌঁছালেও এলাকাবাসীর উন্নয়নে কাজ করতে পারলে তা আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
মাইকে মাইকে নির্বাচনী প্রচারণার গান। পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে আছে রাজপথের অলিগলি। আগের দিনে কেবল স্লোগান আর মাইকিং ছিলো। পোস্টার ছিলো। রঙ্গিন পোস্টারও ছিলো। খরচ নিয়ন্ত্রণে রঙ্গিন পোস্টারের উপর নিষেধাজ্ঞা আসলো।
এখন প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণা। প্রচারণার জন্য অডিওভিজু্য়াল এর প্রভাব বেশী। গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গান বানানো শুরু। ‘জিতবে এবার নৌকা’ বেশ জনপ্রিয় হয়। সেই আদলে এবার অনেক অডিও, ভিডিও হয়েছে। কোনো কোনোটা ভাইরাল।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণার পাশাপাশি চিত্রজগতের তারকাদের নিয়েও প্রচারণা চালাচ্ছেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম। ক্যাপশনে লেখেন ‘আজ আমি কি কাজ করেছি বলবো না। বরং যা বলার তা ঢাকাবাসীরাই বলবে। কারণ, তারাই তো এই শহরের মেয়র।’
নিজের ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে ‘সারাদিন ক্যাস্পেইনের অবসরে একটু আনন্দ’, এই ক্যাপশন দিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন আতিকুল ইসলাম।
সেই ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী পাঞ্জাবি ও কালো রঙের শাল গায়ে হাত নাচিয়ে গান গাইছেন, ‘ড্যাগেরও ভিতরে ডাইলে চাইলে মিশাইলি ল সই…’। এসময় পাশে তার বন্ধু খ্যাতনামা মিউজিসিয়ান কাজী হাবলুকে সুরে সুর মেলাতে দেখা যায়।
এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি আফতাবনগরে নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে নিজ হাতে চা বানিয়ে কয়েকজনকে খাওয়ান মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম। চা বিক্রেতার মতো ‘এই চা হবে, চা…চা…, চা খাবেন চা…’ বলে আশপাশের লোকজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের চা পানের আহ্বান সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় তোলে।
পিছিয়ে নেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তিনি জনসংযোগের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারণায় রয়েছেন সরব। গত ২২ জানুয়ারি ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
সেখানে ক্যাপশনে লিখেছেন ‘আপনাদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করছি আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার। আর কেউ শুনুক আর না শুনুক, আমি শুনছি।’
তাবিথ আরও বলেন, আমি জানি সমস্যা অনেক, সেগুলোর সমাধান নিয়ে আমি আসছি। আসছি অদম্য ঢাকার এক অঙ্গীকার নিয়ে।
নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিতে কম যাচ্ছেন না দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ও বিনএপি মনোনীত প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন। তারা দুজনই সমান সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চালাচ্ছেন ব্যাপক প্রচারণাও।
মেয়রদের প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণার পাশাপাশি কাউন্সিলররাও পিছিয়ে নেই। আওয়ামী লীগের মনোনীত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নং ওয়ার্ডের প্রার্থী আসিফ আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, চলমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জনজীবনের অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচার তাই আর কেবল অফলাইনের আঙিনায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারছি না। আমি নিজে আমার ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা ধরে জনসংযোগ করছি। এর পাশাপাশি অনলাইনে বিভিন্ন এলাকার প্রচারণার ভিডিও ফুটেজসহ এলাকার উন্নয়নে আমার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছি।
তবে প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণায় মন্দদিক বিভিন্ন গুজব, অসত্য তথ্য এসব থেকে এলাকাবাসীকে দূরে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৩১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ডেইজী সরোয়ার নিজের অংশগ্রহণে করেছন মিউজিক ভিডিও। যা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল তিনি।
৩১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া অপুও চালাচ্ছেন ডিজিটাল প্রচারণা। তিনি জানান, প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণার মাধ্যমে এলাকাবাসীর কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি নির্ভর নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যুগটাই প্রযুক্তির, সারা দুনিয়াই প্রযুক্তির ওপর চলে। এখন চাহিদাটাই প্রযুক্তি নির্ভর তাই প্রার্থীরা সেটা লুফে নিয়েছে।
ড. নূরুল আমিনের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবন চলবে না। নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার জন্য প্রযুক্তির সহায়তা লাগবেই। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যার মাধ্যমে ভোট হবে সেটাও কিন্তু একটা প্রযুক্তি। প্রযুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বেও নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রযুক্তি আমাদের যেভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাতে করে প্রযুক্তি বাদ দিয়ে আমরা নির্বাচন করতে পারব না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার আসবে।
প্রযুক্তি নির্ভর নির্বাচনের মন্দ দিক নিয়ে তিনি বলেন: প্রযুক্তি দিয়ে প্রার্থীরা হয়তো অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সেই মানুষের মন জয় করা সম্ভব। এটা এক ধরণের প্রচারণা। মূল বিষয়টি হচ্ছে রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে। দুই সিটিতেই মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশার জায়গা পূরণ হচ্ছে না। গেল বছর ডেঙ্গুতে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। এর পাশাপাশি নগরীতে যানজট থেকে শুরু করে পানির সমস্যাসহ অনেক সমস্যা রয়েছে। সেই সমস্যার আদলে আমরা যখন প্রতিশ্রুতি দেখি সেটার কোনো বাস্তবায়ন দেখি না। এবং মেয়ররাও হয়ে গেছে একটা সামাজিক শ্রেণীর। মেয়রকে আমরা সমস্ত শ্রেণীর মেয়র হিসেবে পাচ্ছি না। কাউকে দেখছি অভিজাত শ্রেণীর প্রত্যাশা পূরণে ব্যস্ত কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অবহেলিত।
তবে প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে রাজধানীবাসী। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আলী নূর পলাশ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণা নির্বাচনে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
প্রযুক্তি নির্ভর প্রচারণায় রয়েছে মন্দদিকও। উচ্চ শব্দের মাইকিংয়ে নাগরিকরা পড়ছেন নানা ভোগান্তিতে। মগবাজার এলাকার বাসিন্দা সারোয়ার জাহান ঠিক তেমনটাই জানালেন।
তিনি বললেন, প্রার্থী প্রায় ২৪ ঘণ্টাই প্রচারণায় ব্যস্ত। উচ্চ শব্দে মাইকিং, প্রচারণা কেন্দ্রে গান বাজনা প্রচণ্ড বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাদের লেখাপড়াতেও সেটার প্রভাব পড়ছে। প্রার্থীদের প্রচারণার ‘কি করা যাবে আর যাবে না’ সেটা বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু করা উচিত।
নির্বাচনকে সামনে রেখে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ছবি জুড়ে দিয়ে ‘গুজব’ সৃষ্টির অপচেষ্টা ঠেকাতে মাঠে থাকবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নির্বাচনের সময়ে ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশি ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও বাস্তবতার নিরিখে যদি আরো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সেটাও করব।