তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ হয়, সেই প্রবণতা বন্ধে ৫৭ ধারার মতো বিধান থাকা উচিত। এমন মতামত খোদ শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেও বিভিন্ন সময়ে এসেছে। ফেসবুকে এরকম তর্ক বিভিন্ন সময়ে উঠেছে এবং ‘উত্তম বিকল্প’ তৈরির আগ পর্যন্ত ৫৭ ধারা থাকা উচিত বলে মত দিয়েছিলেন, এরকম একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও সম্প্রতি ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে।
ফলে সোমবার মন্ত্রীসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি অনুমোদিত হবার পরে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ধরনের তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, এই ‘উত্তম বিকল্প’ নিয়েও এখন নাগরিকরা শঙ্কিত।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত চরিত্র হরণ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ইত্যাদি বন্ধের জন্য করা হয়েছে । এমন যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছিল যে, এটি স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরবর্তীতে এই আইনের আলোকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমন অনেক মামলা হয়েছে যা শুধু স্বাধীন সাংবাদিকতাকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং একটা ভীতির সংস্কৃতি সমাজে জিইয়ে রেখেছে।
অনেকেই বলেন, ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। এ কথার অর্থ হলো, এই আইনের ভালো প্রয়োগও আছে। আসলে কি তাই? তথ্যপ্রযুক্তি আইনেরে এই ধারাটির কি কখনো ভালো প্রয়োগ হয়েছে?
এ প্রসঙ্গে সব সময়ই যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, ফেসবুক ব্যবহার করে অনেকেই যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন, সমাজে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করেন, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেন, সেগুলো বন্ধের তাহলে উপায় কী? ৫৭ ধারার মতো বিধান থাকলেই কি এগুলো বন্ধ হয়? তা তো হয়নি। আবার ৫৭ ধারার বিধান শিথিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারায় যে তুলনামূলক উত্তম/শিথিল বিধান আনা হয়েছে, তাতে কি ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানির মতো লেখালেখি অথবা ফেসবুক পোস্ট কমবে?
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যে বিধান রয়েছে, যে অপরাধ ও সাজার ব্যবস্থা রয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সেই অপরাধগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তবে এর ১৯ ধারার সাথে বিতর্কিত ৫৭ ধারার মিল রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা, অশ্লীল এবং যা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে; অথবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পাঠ করলে বা দেখলে বা শুনলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, তাহলে তিনি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনের ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারায় শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় কেউ অপরাধ করলে তার অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। পক্ষান্তরে নতুন আইনের ১৯ ধারায় কেউ অপরাধ করলেও সেটি জামিনযোগ্য।পার্থক্য এটুকুই।
(২) ব্যক্তিগত আক্রমণের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা বন্ধেও এই আইনে বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো প্রোপাগান্ডা হলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
কথা হচ্ছে এই বিধান কি খুব অযৌক্তিক? মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে নানা সময়েই বিতর্ক তোলা হয়েছে। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য লজ্জার যে, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি সর্বজনীন বিষয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই। খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সনও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের যে সংখ্যা বলা হয়, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষ করে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তখন এ জাতীয় মন্তব্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের যে উৎসাহিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিয়মিত বিরতিতে জাতির জনককে নিয়ে যে ধরনের ‘ইতিহাস’ চর্চা করেন এবং তাঁকে হেয় করার অপচেষ্টা করেন, তাতে এরকম একটি বিধান থাকা উচিত বলে মনে করা হয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে।
ধরা যাক, কোনো একটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বা অন্য কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করলেন যা এই আইনের ধারাবলে শাস্তিযোগ্য, তখন শাস্তি হবে কার, যিনি খবরটি কোনো অনলাইন সংবাদপত্র বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করলেন তার নাকি যিনি মন্তব্য করেছেন? নাকি উভয়ের? কারণ যতক্ষণ না মন্তব্যটি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে আসছে, ততক্ষণ কাউকে অভিযুক্ত করা যাচ্ছে না। তার মানে একই মন্তব্য যদি কেউ প্রকাশ্যে জনসভায় করেন এবং সেটি যদি অনলাইনে না আসে, তাহলে কি তাকে এই অপরাধে শাস্তি দেওয়া যাবে না? আবার খবরটি যদি সংবাদপত্র বা টেলিভিশন প্রকাশ ও প্রচার করে, সেক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকে কি দায়ী করা যাবে?
ধরা যাক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো গবেষক বা লেখক এমন কিছু তার বইতে কিংবা পত্রিকায় লিখলেন যা প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুর কোনো কাজকে চ্যালেঞ্জ করে বা প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন ওই লেখাটি ইন্টারনেটে প্রচারের দায়ে কার শাস্তি হবে? যিনি গবেষণা করলেন তার নাকি যিনি ওই লেখাটি ইন্টারনটে বা আরও পরিস্কার করে বললে ফেসবুকে শেয়ার করলেন, তার? এই যদি হয় তাহলে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে স্বাধীন গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করবে কি না?
তাছাড়া কোন লেখাটি বা কোন তথ্যটি মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুকে হেয় করলো, সেটি কে নির্ধারণ করবে? সেটি যদি নির্ধারণের দায়িত্ব থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আদালতের, সেটি নির্ধারিত হবার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ধরনের হয়রানির শিকার হবেন, তার দায়ভার কে নেবে?
আবারও সেই পুরনো প্রশ্ন। এতসব বিধান করে ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি বা অশ্লীলতা বন্ধ করা যাবে? কেননা যন্ত্রের ব্যবহার নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর। ইন্টারনেট একদিকে যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছে, তেমনি এখানে পর্নোগ্রাফির দরজাও উন্মুক্ত।
এখন আমি ইন্টারনেটে কোন কাজে লাগাব, সেটি তো নির্ভর করছে আমার ব্যক্তিগত শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি, মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতার উপর। এ সম্পর্কিত কোনও আইন বা বিধান না থাকলেও অধিকাংশ মানুষই ফেসবুকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবে না। আবার যত কঠিন আইনই থাকুক না কেন, কিছু লোক এগুলো করবেই। সেক্ষেত্রে কঠিন আইন করার চেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা জোরদার করা। আমার সন্তানকে আমি কীভাবে গড়ে তুলছি, তারউপর নির্ভর করবে বড় হয়ে সে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক পোস্ট দেবে কি দেবে না। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবে কি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)