অতীতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য বারবার শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গত কয়েক বছর ধরে শিরোনাম হওয়ার কারণ সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সর্বশেষ ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডেকেছেন তার অনুসারীরা। দিয়াজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্মসম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। গত সপ্তাহে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে দিয়াজের মতো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন ছাত্রনেতা আত্মহত্যা করতে পারেন। তার মরদেহ উদ্ধারের আগের রাতেও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন নিয়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তবে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘আত্মহত্যা’র কথাই বলা হয়েছে। দিয়াজের পরিবার এবং অনুসারীরা ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার অনুসারীরা অবরোধ ডাকার আগে দিয়াজের পরিবার আদালতে মামলার যে আর্জি জানিয়েছেন, সেখানে যে অভিযোগ এনেছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন; তাতে আরো একবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে ছাত্ররাজনীতি। অভিযুক্তদের তালিকা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। দিয়াজের মা জুবেয়দা সারোয়ার চৌধুরীর আর্জিতে অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু, কর্মী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরোব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমান। অভিযুক্তদের মধ্যে একদিকে যেমন আছেন দিয়াজের সংগঠনেরই সাবেক ও বর্তমান ‘সহযোদ্ধা’, তেমনই আছেন তার শিক্ষক যিনি আবার সহকারী প্রক্টর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। চ্যানেল আই অনলাইনের সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এদের সঙ্গে দিয়াজের দ্বন্দ্বের মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কার্যাদেশ যা সাধারণের কাছে টেন্ডার হিসেবে পরিচিত। যে দেশের ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, ১৯৬৯ এবং ৯০ সালে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করেছে সেই ছাত্ররাজনীতির আজ এ কোন হাল! এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ঠিক এ সময়টাতেই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হচ্ছিল। ছাব্বিশ বছর পর আজ সেই ছাত্ররাজনীতি খুনোখুনি এবং টেন্ডারবাজির দায়ে অভিযুক্ত। মূলতঃ ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের পরই ছাত্ররাজনীতির এ অধপতনের শুরু। দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের পাশাপাশি যে শিক্ষককে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তিনিও একসময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এখনো তিনি ছাত্রলীগের গ্রুপিং-এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। উদ্বেগের বিষয় হলো এরকম ঘটনা শুধু এক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ নয়। এ টেন্ডারবাজি ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ক্যাম্পাসগুলোতে সব সহিংসতার অন্যতম মূল কারণ টেন্ডারবাজি। সময় সময় রক্তাক্ত ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, ছাত্ররাজনীতিকে ছাত্রকল্যাণের পথে আনার বিষয়ে কথাবার্তা হয়, কিন্তু তার পর আমরা ভুলে যাই। আমরা যখন একটি উন্নত দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছি তখন আগামীদিনের নেতৃত্ব গঠনে ছাত্রদের গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু, ছাত্ররাজনীতি যেন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দুর্বৃত্তদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্যও উদ্যোগী হওয়া জরুরি।