৭১ দেখিনি! তবে সে সময়ের স্লোগানগুলো আলোড়িত করে মনকে বাংলা মায়ের সন্তান হিসাবে। ৭১ নিয়ে বির্তক হতে দেখলে ব্যক্তি জীবনের অনুভূতিতে বেদনার সুর বেজে উঠে।
আইনজীবী ড.বশির আহমেদ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে এক রিট আবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে গত ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলার মৌখিক আদেশ দেন।
এ ঘোষণা জাতির জন্য আইনগতভাবে প্রত্যাশার আলো। কিন্তু জাতিগত বাঙালি বোধের আবেগে পীড়াদায়ক। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাংলাদেশ – এ ৩টি শব্দ দিয়ে জাতি লাল সবুজের পতাকার জন্য লড়াই করেছে ১৯৭১ সালে। আর যুদ্ধের সে সময়টাতে সারাদেশে একটা স্লোগানই বাংলার মানুষকে এক করেছে, আর তা হলো ‘জয় বাংলা’।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এই দেশের মানুষের মাঝে ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ছিলো না। সবার পরিচয় ছিল একটাই ‘আমি জয় বাংলার লোক।’ এমনকি ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালিদের বলা হত জয় বাংলার মানুষ। আবার সে সময় চোখের একটি রোগকে বলা হত ‘জয় বাংলা রোগ’।
সাধারণ মানুষের প্রচলিত কথার অনেক উর্ধ্বে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মর্মার্থ। ৭ মার্চের স্বাধীনতার ভাষণ শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্ঠের ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানটি আজও শিহরিত করে মানুষকে। এ স্লোগানে উচ্চারিত প্রতিটি অক্ষর বাংলা মায়ের সন্তানদের দেশত্ববোধকে জাগ্রত করে আপনা হতে৷ আর সে কারণে বাংলার মুক্তি সেনারা ৭১ এ যুদ্ধের মাঠে এই একটি স্লোগান দিয়ে পরাজিত করেছেন পাকিস্তানিদের।
যে স্লোগানে সমগ্র জাতি এক হয়েছে, ধমনীতে জেগেছে প্রতিবাদ প্রতিরোধের স্পৃহা ; সে স্লোগানকে আজীবন ধারণ করতে না পারা বিবেককে দংশন করে দেশ প্রেমীদের।
তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া ৭১ পরর্বতী প্রজন্মের কাছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি হয়ে গেল একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ -স্লোগান এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে৷ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জয় বাংলা স্লোগানকে আর আত্মিকভাবে একাত্ম হয়ে ধারণ করতে পারেনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ। এ ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক দলের। তারা নিজেদের স্বার্থে সুবিধামত ব্যবহার করছে বাঙালির আবেগকে। জাতিকে এক পতাকার তলে রাখার বদলে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি নিষিদ্ধ হলো ৭৫ পরর্বতী সময়ে। এটি হলো আওয়ামী লীগের স্লোগান। রাজনৈতিক মত বিরোধকে প্রাধান্য দেয়া নেতারা ভুলে গেল, বাংলার মাটিতে তারাও লড়াই করেছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে।
তবে নির্মম সত্য হলো, যারা জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করতে পারে; তাদের কাছে দু অক্ষরের স্লোগানের কি বা মুল্য থাকবে!
বাঙালির দেশ প্রেম এখন রাজনীতিবিদের খেলার হাতে বন্দি। জয় বাংলাকে দলীয় স্লোগানের ফ্রেমে আবদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ‘জয়বাংলা ও বঙ্গবন্ধু ‘ কোন দল বা ব্যক্তির সম্পদ নয়। এ চিন্তা আর চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি বলে আজ বাংলাদেশে হাইকোর্টের আদেশের প্রয়োজন হয় ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য।
অথচ ভারতে দল মত নির্বিশেষে গান্ধীজির ছবি আর জয় হিন্দ শ্লোগানকে যুগ যুগ ধরে ধারণ করে আসছে। এ বিষয়গুলোতে তাদের কোন মতাভেদ নেই। দেশের স্বার্থে জয় হিন্দ বলে তারা এক হয়ে যায়৷ আর বাংলাদেশে ক্ষমতার পালা বদলে জাতির পিতার ছবির অবমাননা অতীতে বারবার হয়েছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলবে এটা চিন্তা করা ছিল কল্পনাতীত।
হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে কথা বলা অন্যায়। তবু ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানের নির্দেশ দেখে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলে এ আদেশ কার্যকর হবে। যদি আগামীতে এ চিত্র না থাকে, তখন আইন কতোটা কার্যকর হবে? আরেক রিটে বদলে যাবে কি আদেশ? দেশের সংবিধানে আজ অবধি এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে সংযুক্ত হয়নি। সেখানে মানুষের মনের প্রশ্ন অবান্তর নয়।
আবেগ এবং আইনের বিপরীতমুখী অবস্থানে মাননীয় আইনজীবীর এ রীট সাধুবাদের যোগ্য। ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানটি জাতির প্রাণকে সঞ্চারিত করেছিল বলে লাল সবুজের বিজয় পতাকা আকাশে উড়েছে। তাই এ স্লোগানটিকে আত্মিকভাবে ধারণ করে প্রতিটি বাঙালি দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশা সবার কাছে। কেননা একটি দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা আসে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে। আর বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রযাত্রায় ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানটি আত্মার টানে বেজে উঠলেই জাতি উদীপ্ত হবে নতুন এক বাংলাদেশের জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)