সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবার নামে নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয় রোগীদের। মীমকে মৃত ঘোষণা করা ও পরবর্তীতে তাকে শেষ গোসল দেয়ার মুহূর্তে কান্না এসব হয়রানিরই একটি দৃষ্টান্ত বটে। কিভাবে ঘটলো এমনটি? ঘটনাটি ঘটলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জীবিত মীমকে কেন মৃত ঘোষণা করলো?এটা কি তাদের চরম খামখেয়ালীপনা নয়?রাজধানীর হাসপাতালের চিত্রই যদি এরকম হয় তাহলে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কী হতে পারে?মীম কি আর্তচিৎকার দিয়ে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর একটি সচিত্র প্রতিবেদন দৃশ্যমান করে গেলো না? ডাক্তার যদি জীবিত মীমকে সময় থাকতে চিকিৎসা সেবা দিতো তাহলে কি সে বেঁচে ওঠে আবার মারা যেতো? মীম মরতে চায়নি, বাঁচার আকুতিতেই সে হয়তো আর্তচিৎকার দিয়েছে।
কি আছে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে? রক্তপরীক্ষা, এক্সরে, ইসিজি এসব নিয়ে চলছে ডাক্তার ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি ব্যবসায়ীদের কমিশন বাণিজ্য। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। কারণ তারা তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য ডাক্তারদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে। অধিকাংশ হাসপাতালে এক্সরে ও অন্যান্য পরীক্ষার কোন যন্ত্রপাতি নেই। সরকার বরাদ্দ দিলে উচ্চমূল্যের বিল ভাউচার দেখিয়ে কম দামের যন্ত্রাংশ কিনে নিজেরা লাভবান হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা বলতে থাকে মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।মেরামত করে না আনা পর্যন্ত রোগীদেরকে বলা হয় বাইরে গিয়ে পরীক্ষাগুলো করাতে। ডাক্তাররা নিজেদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে রোগী প্রেরণ শুরু করেন। পেতে থাকেন কমিশন।
সরকারি হাসপাতালে রোগীদের খাদ্য সরবরাহ করে একশ্রেণির প্রভাবশালী ঠিকাদার। এখানেও চলে অনিয়ম। রোগীদের উপযুক্ত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ হয়না অধিকাংশ হাসপাতালে। কেউ ভয়ে প্রতিবাদও করেনা। অথচ প্রতি হাসপাতালেই রয়েছে সরকারি বেতনভূক্ত বাবুর্চি, বুয়া ও আয়া। হাসপাতালের শয্যাগুলোতেও নেই পরিচ্ছন্নতা অভিযান অথচ এখানে রয়েছে সরকারি বেতনভূক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী। অনেক হাসপাতালে নাইট গার্ডকে দেখা যায় আরেকজন নাইট গার্ড নিয়োগ দিয়ে নিজের মাসিক বেতন ভাতার পুরো সুবিধা ভোগ করতে। আরেকটি বিষয় হলো টেন্ডারবাজী। হাসপাতালের উন্নয়নের কথা বলে সরকারের রাজস্বকোষ হতে টাকা এনে তা লোপাট করা হয়।
অধিকাংশ হাসপাতালেই চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক, নার্স কিংবা চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থা নেই। সকাল ৯টা হতে দুপুর ২টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা কোনমতে দায়সারাভাবে বসে ফ্রি রোগী দেখে। সুযোগ পেলে এসময়েও ফি নিতে ভুল করেনা। চিকিৎসা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার বাস্তবায়ন করবে চিকিৎসকরা। অথচ এই অন্যতম জনগুরুত্বপূর্ণ পদে শূন্য পদ কত? কেন এই শূন্য পদগুলোকে পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয়া হচ্ছে না? বাংলাদেশের ভিভিআইপিরা চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে চলে যান। কিন্তু তারা কি পারেন না তাদের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবার মতো করে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবাকে উত্তীর্ণ করতে? সরকারি হাসপাতালের দামী ওষুধগুলো কারা পায়?এখানেও মুখ চিনে মুগের ডাল অথবা খেসারীর ডাল দেয়া হয়। যার কেনার সামর্থ্য আছে তাকে দেয়া হয় দামী ওষুধ আর যার কেনার সামর্থ্য নেই তাকে দেয়া হয় কমদামী ওষুধ।
খুব মজার কথা বলতেন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জসীম উদ্দীন মন্ডল। রসিয়ে রসিয়ে নানান মজাদার উপমা দিয়ে কথা বলতেন তিনি। একটি জনসভায় বলেছিলেন, আমি একবার হাসপাতালে গিয়েছিলাম, পেটব্যথার ওষুধের জন্য। ডাক্তার আমাকে ধরিয়ে দিল মায়াবড়ি। এই কথা তিনি বলেছিলেন প্রায় দুই যুগ আগে। আজকের সময়ে বিশৃঙ্খলা আরও চরমে। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন জাগে, এজন্য দায়ী কি জনগণ? নাকি সরকার? নাকি ব্যবস্থাপনা ও খামখেয়ালী? মীম বুঝি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল হাসপাতালগুলোর ব্যর্থতার দিক। জীবিত মীমকে মৃত ঘোষণা করলো হাসপাতালের ডাক্তার। সকলকে চমকে দিয়ে মৃত মীম জীবিত হয়ে উঠল। এরপর কি? জীবিত মীমকেও জীবিত রাখতে পারলো না তারা। মীম চিৎকার করে তার বেঁচে থাকার আকূতি প্রকাশ করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মীম ইস্যুতে কী ব্যাখ্যা দেবে? জীবিত মীমকে কেন মৃত ঘোষণা করা হলো?মৃত মীম জীবিত হয়ে উঠলেও কেন তাকে জীবিত রাখা গেলনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)