‘ঋণখেলাপি’ শব্দটার মধ্যে কি আভিজাত্য আছে? ইদানিং তাই মনে হচ্ছে। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার মধ্যে একটা সম্ভ্রান্ত সম্ভ্রান্ত ভাব আছে।
যেমন পাড়ায় কোনো বাড়ির মানুষ একটা নতুন গাড়ি কিনলে সেটা যখন বাড়ি থেকে চালিয়ে বের হয়, তখন আশেপাশের মানুষ দেখে একে অন্যজনকে বলে, দেখ নতুন গাড়ি কিনেছে। জাতে উঠে গেল দেখতে দেখতে লোকটা।
ঠিক তেমনি বর্তমানে অমুক বাড়ির তমুক পাঁচ-দশ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। তার নামে ব্যাংক মামলা করেছে। পত্রিকায়ও তার নাম এসেছে। ছবিও ছাপা হয়েছে কোথাও কোথাও। বেশ মুডেই আছে লোকটা। সবাই তাকে দেখে একটু অন্যভাবে তাকালেও লোকটার মধ্যে বিন্দুমাত্র বিব্রত হওয়া তো দূরেই থাক, উল্টো বেশ ভারিক্কি চালেই চলাফেরা করছে।
পাশাপাশি গ্রামের কোনো কৃষক কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল ক্ষতি হওয়ায় ঋণ ফেরত দিতে না পারলে তাকে রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে পত্রিকায়। সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের লোকজনও ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পারায় নাকের নোলক খুলে নেওয়া থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি ক্রোক করার অনেক ঘটনা প্রচলিত আছে।
গত কয়েক বছর ধরে আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পারি আমাদের সরকারি ব্যাংকে লুটপাট হয়ে গেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও। কারা সেটা করেছে সেটাও সরকার জানেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা পত্রিকায় দেখলাম না ওমুক ব্যাংকের তমুকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বেসিক ব্যাংকের নাম আমরা রূপকথার গল্পের মতো মনে রেখেছি। কিন্তু কারো কি কিছু হয়েছে? জানা নেই আমাদের। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের পড়তে হয় অমুক জেলার তমুক উপজেলার একজন গৃহবধু আত্মহত্যা করেছে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পেরে। তার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করেছিল তমুক ব্যাংক।
এর মানে কী? গরিব মানুষ হলে চাপ দাও আর ধনী হলে এড়িয়ে যাও…এই রীতিতে চলছে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর?
আরেকটা বিষয়, প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে আমরা শুনি এবারও জনগণের করের টাকা দেয়া হবে ব্যাংকিং সেক্টরকে চাঙ্গা করার জন্য। তার মানে হচ্ছে চোরেরা চুরি করবে বা ঋণখেলাপিরা ঋণ নিয়ে ফেরত দিবে না আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ যে যৎসামান্য কর দিয়ে থাকি সেখান থেকে টাকা নিয়ে দেয়া হবে চোরদের? কি তামাশা!
সম্প্রতি দেখলাম ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও সময় বাড়িয়েছে। এ নিয়ে ৫ দফা সময় বাড়ানো হলো। ইতোমধ্যে যারা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করেছেন তাদের সুবিধা দিতে এই বাড়তি সময় পাবে ব্যাংকগুলো।
কি তামাশা! কী পরিমাণ জামাই আদর ভাবা যায়? বিষয়টা এমন যেন- কী আর করবে মেয়ে দিয়ে যখন জামাই করা হয়েছে, সুতরাং মেয়ের সুখের কথা ভেবে এই ছাড় আর কি!
কার নির্দেশে এই জামাই আদরের ব্যবস্থা করছে সরকার? কোন সে মহামানব? কোন সে কামেল মানুষ আকাশ থেকে হাত ইশারা করছেন? কোন সে মানুষ সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এই বাণী দিচ্ছেন আর সরকার গোগ্রাসে গিলছেন, আমাদের জানার কথাও না। দেশের শেয়ার বাজারকে ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতি বছর প্রণোদনার নাম করে কোটি কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে নিয়ে তছরুপ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষ শেয়ার বাজারে থেকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সব মিলিয়ে ঋণখেলাপিরা এই দেশের অর্থনীতিকে শেষ করে দেবে বললে কম বলা হবে, বলা উচিত ধ্বংস করে ছাড়বে। আর সরকারের খুব কাছের লোকজনই এই ধ্বংসের মূল কারিগর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন তা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে এই শুদ্ধি অভিযানে যেন ঋণখেলাপিদেরও হিসেবে রাখা হয়। কারা কত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন তা তদন্ত করে দেখা উচিত।সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুইয়া বলেছেন, ঋণখেলাপিদের একটি অংশ বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকে।
সরকারের কাছে তাই আবেদন – জামাই আদর করে যাদের দুধ কলা খাইয়ে বড় করছেন তারা দেশকে ধ্বংস করে কোথায় নিয়ে ফেলবে তা একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে এখন। ঋণখেলাপিরা আর ইসমাইল হোসেন সম্রাট বা খালেদ মাহমুদ ভুইয়াদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। সব সময় কামেল-দরবেশদের কথা শুনে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেন না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাকে ধ্বংস করার জন্য খন্দকার মোশতাকের দোসররা এখনও রাজনৈতিক দরদাম করে নানা বেশ ধরে দরবেশ এর ভান ধরে বসে আছে আপনার চারপাশেই।
ঋণখেলাপিদের টুটি চেপে ধরুন এখনই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)