আমি তখন কলেজে পড়ি। কলেজটি (শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ) ময়মনসিংহ টাউন হলের মোড়ের পাশে অবস্থান করায় নানাবিধ রাজনৈতিক কর্মসূচি আমাদের গোচরীভূত হতো। কেননা, টাউন হলের মোড় ও সার্কিট হাউজ সংলগ্ন রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ কর্মসূচি পালিত হতো। একদিন আমাদের ইংরেজির স্যার শ্রেণিকক্ষে বললেন, টাউন হলে আজকে একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে কেউ যাবে না।
কারণ হিসেবে তিনি বললেন; সেখানে আজকে এমন একজন নেতা বক্তব্য প্রদান করবেন যার বক্তব্য শেষ না করে তোমরা সমাবেশস্থল থেকে বের হতে পারবে না (সময়ের কালক্ষেপন হবে)। স্যারের নিষেধ শুনে আমাদের আগ্রহ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আমার তো মনে হয়, স্যার প্রকারান্তরে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মিটিং এ অংশগ্রহণে বিরত থাকতে বলেছেন। পাশাপাশি তিনি এও জানতেন যে, এ বয়সের ছেলেদের নিষেধাজ্ঞার প্রতি প্রবল উৎসাহ, উন্মাদনা থাকে যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমাদের নিষেধ করেছিলেন।
কলেজের ক্লাশ শেষে আমরা কয়েকজন একসাথে আলোচনা শুনতে যাই। সকলের দৃষ্টি ছিল অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির দিকে এবং বিশেষ করে আমরা তাঁকে উদ্দেশ্য করেই আলোচনা শুনতে এসেছি। যথারীতি তিনি বক্তব্য শুরু করলেন এবং আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম। কি ছিলো না সেই বক্তব্যে? প্রায় ঘন্টাব্যাপী বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ সহ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখপূর্বক নানাবিধ বিষয়ে যে আলোকপাত করলেন প্রকৃত অর্থে সে বক্তব্য শেষ না করে সমাবেশস্থল ত্যাগ করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
এখানে বলে রাখা ভাল, সেই জনসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ জননেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ এমপি। বর্তমান রাজনৈতিক হালচাল দেখে আমার মাঝে মধ্যে প্রায়শই স্যারের নিষেধাজ্ঞা (প্রকারান্তরে জনসমাবেশে যাওয়ার জন্য আগ্রহ তৈরি) এবং সে জনসভার কথা মনে পড়ে। কেননা, রাজনীতিবিদরা অনেকের জন্যই অনুকরনীয় ও অনুসরনীয় হয়ে ওঠেন তাদের কর্মকাণ্ড এবং প্রজ্ঞার কারণেই।
আমার আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে; সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় স্থান পাওয়া একটি বিষয়কে নিয়ে আলোকপাত করা। জাতীয় পার্টি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এবং সারা বাংলাদেশে তাদের জনসমর্থন রয়েছে। সরকারের বিগত দুই মেয়াদে জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদার হয়ে কাজ করেছে এবং বর্তমান সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেছে। তারপরও জাতীয় পার্টির গৃহীত নানাবিধ সিদ্ধান্তে দলটি বিভিন্ন সময়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করে, বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা রকমের বিদ্রুপাত্নক ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য উঠে আসে। পাশাপাশি দলটির শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্রের বিধান নিয়ে জনসাধারণের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়ে থাকে।
জাতীয় পার্টিতে সর্বশেষ দলটির কো-চেয়ারম্যানের পদ এবং সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকে এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অব্যাহতির কয়েকদিন পরে জিএম কাদেরকে দলীয় পদে পুনর্বহাল করা হয়। এইযে দুই দিন পর পর দলের চেয়ারম্যান নিজের ইচ্ছেমতো যথাযথ নিয়মকানুনের অনুসরণ না করেই দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বিষয়টা রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে অবশ্যই জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতার কারণে হয়তো দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মুখ ফুটে কিছু বলছে না। কিন্তু দলের অনেক নেতাই চেয়ারম্যানের এহেন সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছে না। কিছুদিন পূর্বে জাতীয় পার্টির মহাসচিব নিয়ে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে তা কোন রাজনৈতিক দলের জন্য শোভনীয় নয়। দুইদিন পর পর পত্রিকায় প্রেসনোট পাঠিয়ে যে সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয় দলটির পক্ষ থেকে সেসব সিদ্ধান্ত সচেতন রাজনৈতিক মহল কর্তৃক তিরষ্কৃত হয়ে আসছে।
রাজনীতির এ লীলাখেলায় অদ্ভুত সব সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে নানাবিধ ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়েছে। প্রথমত: সাংগঠনিকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে সুসংহত অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি (ক্ষমতায় থাকার ফলে যেভাবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করার কথা)। দ্বিতীয়ত: দলীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক চর্চার বহি:প্রকাশ ঘটেনি, দু-চারজনের হাতেই দলীয় ক্ষমতার সব কিছুই আচ্ছাদিত রয়েছে। তৃতীয়ত: তৃণমূলের সাথে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভাসমান সংস্কৃতি বহমান থাকায় দলীয় কর্মসূচিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সার্বিক অংশগ্রহণ দেখা যায় না। চতুর্থত: দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা প্রকৃত রাজনৈতিক দলের চরিত্রের বিপরীতমুখীতা বহন করে। শেষত: নতুন কর্মী সমর্থকদের জাতীয় পার্টির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা (বাস্তবিক কর্মকাণ্ডের কারণে)। ফলশ্রুতিতে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অনেকটাই শঙ্কাময়।
রাজনীতির সমীকরণে যে কোন সিদ্ধান্ত ভেবে চিন্তে নেয়া উচিত। নিজের খেয়াল খুশিমতো দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দলকে হাসির খোরাকে পরিণত করার অধিকার তৃণমূল নেতাকর্মীরা কাওকেই দেয়নি। কারণ, দলের মূল শক্তি হচ্ছে তৃণমূল এবং তাদের সমর্থকরা। তাদেরকে থোড়াই কেয়ার করে, মতামতকে উপেক্ষা করে কোনরূপ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনুচিত। কারণ, রাজনীতিবিদদের প্রজন্মের অনেকেই অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় মনে করে থাকে। আবার অনেকের অযৌক্তিক ও অযাচিত আচরণে একটা বিশেষ শ্রেণীর প্রতি প্রজন্মের বিদ্বেষ চলে আসে। প্রকৃত অর্থে, দায়িত্বশীল অবস্থায় থেকে দায়িত্বশীলদের আরো বিনয়ী ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায়, হিতে বিপরীত হওয়ার অজস্র উদাহরণ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দৃশ্যমান রয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)