‘তুলি দুই হাত
করি মোনাজাত
হে রহিম রহমান
কত সুন্দর করিয়া ধরণী
মোদের করেছ দান’
এই কবিতা প্রতিটি শিশু কিশোরদের শৈশবের সাথে জড়িত। আমাদের শৈশবকে পূর্ণতা দিয়েছেন সুফিয়া কামাল এমন বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ পুরুষ নির্ভর বাংলা পাঠ্যবই সুফিয়া কামালের কবিতা না থাকলে যেন নারীদের কোন ভূমিকাই থাকতো না।
হেমন্ত, জন্মেছি এই দেশে, আজিকার শিশু’র মতো কবিতাগুলো আমাদের স্বদেশপ্রেম, নৈতিকতার পাঠ দিয়েছিলো। বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া, নূরজাহান বেগমের পাশাপাশি যার নাম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করা হয় তিনি সুফিয়া কামাল।
নারী মুক্তি, গণতন্ত্র, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা মহিয়সী নারী সুফিয়া কামালের জন্মদিন আজ। ১৯১১ সালের এই দিনে বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে নানার বাড়িতে ১৯১১ সালের ২০ জুন (সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, বেলা ৩টায়) জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
সুফিয়া কামাল কেবল একজন কবি নন, তিনি একজন সংগঠক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক চরিত্র। যার লেখনী, বলিষ্ঠ চরিত্র আর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা তাকে ইতিহাসের পাতায় করেছে অনন্য। সুফিয়া কামালের জন্ম-মৃত্যু বা তাঁর কবিতা নিয়ে আমরা ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছি।
১৯১১ সালে বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্ম এই মহিয়সীর। জন্মের সময় নাম রাখা হয় সুফিয়া খাতুন। সুফিয়া খাতুনের বয়স যখন ৭ মাস, তখন বাবা সৈয়দ আবদুল বারী নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন, সুফিয়াকে নিয়ে মা চলে আসেন নিজের বাবার বাড়িতে। সেখানেই সুফিয়ার বেড়ে ওঠা। মাতৃকেন্দ্রিক সুফিয়া খাতুন মায়ের চরিত্রের দৃঢ়তাকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন।
নিজের প্রথম গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ তিনি উৎসর্গ করেন মা সাবেরা খাতুনকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সে অর্থে না পেলেও নিজের আগ্রহ আর মা ও বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় তিনি ধীরে ধীরে বাংলা ও ইংরেজি শিখতে শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণের শুরুও করেন। ১৯২৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে হয়। নেহালউদ্দিন প্রগতিবাদী ছিলেন। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় লেখা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
স্বামীর সাথে কলকাতায় অবস্থানের সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান সুফিয়া। সেখানে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন সুফিয়া। ১৯৩২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর আবারো দুর্যোগ নেমে আসে সুফিয়ার জীবনে।
এক মেয়ে আমেনা হোসেন দুলুকে নিয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু হয় সুফিয়ার। এমনি সময়ে সুফিয়াকে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন এডুকেশন অফিসার ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা কর্পোরেশনে স্কুলে চাকরি পান সুফিয়া। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পান কবি আবদুল কাদির, কবি জসিম উদদীন, কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। সুফিয়াকে এই সময় আশ্রয় দেন তাঁর এক জ্ঞাতি বোন।
সেসময় কাজী নজরুল ইসলাম, সাদত আলী আখন্দ, মাহবুব-উল-আলম, আবুল ফজলের মতো সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রেরণা সেই কঠিন সময়ে তাঁকে নতুন অনুপ্রেরণায় বাঁচতে শেখায়। সাদত আলী আখন্দ-ই সর্বপ্রথম সুফিয়াকে কবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় শুরু করেন সাহিত্য চর্চা। তাঁর জীবনের নানা পথ পরিক্রমা তাঁকে শিখিয়েছে সংগ্রামী হতে, তাঁকে শিখিয়েছে দৃঢ় চরিত্র আর বলিষ্ঠ হৃদয়ের অধিকারী হতে।
১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিনের সাথে সুফিয়ার দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহ হয়। বিয়ের পরই তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হন। বিয়ের পর সুফিয়ার কাব্য প্রতিভা বিকাশে অগোচরে থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কবির কবিতা, পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতেন তিনি।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কবি স্বামীর সাথে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। পাকিস্তানে এসে তিনি কাব্যচর্চার পাশাপাশি নারীমুক্তি আন্দোলনেও যোগদান করেন তিনি। সেসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকল্পে শান্তিকমিটি গঠিত হয়েছিলো। লীলা রায়ের অনুরোধে তিনি শান্তিকমিটির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, এই সংগঠনের সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল। ১৯৫১ সালের শেষদিকে সমাজ সচেতন নারীদের নিয়ে গঠিত হয় ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি, যার সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় লবণ ও তেলের দাম বাড়ানো হলে সকল স্তরের ও সংগঠনের নারীরা মন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে রাস্তায় ঘেরাও করেছিলেন, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল।জীবনে যখন যেখানে তিনি অন্যায় দেখেছেন সেখানেই সোচ্চার হয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন। সত্তরের দশকে তৎকালীন বাংলাদেশে তিনি নতুন করে রোকেয়ার বইপত্র প্রকাশ করেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেলের নাম রোকেয়া্ হল রাখা হয়।
সেবছরেই সামরিক শাসন, সরকারি ভয়ভীতি, নিষিদ্ধ রাজনীতির থমথমে পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল্। সেই সময়ই ছায়ানটের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদি গোষ্ঠী ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১’র বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালে ১৯৬৩ সালে বিভিন্ন নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রীর সাথে সুফিয়া কামালও প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি নারীকল্যাণ সংস্থা ও পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’র সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রীত্ব ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে এর সভানেত্রী হন। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলায় রিলিফ বিতরণে নেতৃত্ব দেন।
ব্যক্তি সুফিয়া কামালের সাহস আর স্বদেশপ্রেমের সর্বোচ্চ নিদর্শন হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুদিন আগে ইয়াহিয়া খানের সাথে বুদ্ধিজীবীদের বৈঠকে তাঁর আগুনঝরা বক্তব্যের জন্য পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে নজরদারিতে রাখা হয়। সোভিয়েত সরকার তাঁকে সেদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি যাননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তাঁকে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে থাকতে হয়। এর মাঝেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। নয়মাসে তিনি ৯টি কাঁথা সেলাই করেছেন দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য। নয় মাস ধরে তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তিনি লিখে রেখেছেন, যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সময়ে আলবদর বাহিনী তাঁকেও হত্যা করতে আসে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার জন্য তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়। যুদ্ধ শেষে নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে তিনি কাজ করেন, নারী পুনর্বাসন সংস্থার সদস্য ছিলেন তিনি। মহিলা পরিষদের মাধ্যমে তিনি নারীদের উন্নয়নে সর্বদা কাজে নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তিনি আরো সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে ৮০ বছর বয়সেও তিনি রাজপথে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। ৯০ এর দশকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনেও রেখেছিলেন ভূমিকা।
ছিলেন গণআদালতের সদস্য। গণআদালতের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রণয়নেও ভূমিকা রাখেন তিনি। শিশু সংগঠন কচি কাঁচার মেলা, চাঁদের হাট গঠনেও তিনি ভূমিকা রাখেন। সারাজীবন ১৬টি সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন, পদক পেয়েছেন ৩২টি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মুক্তি আন্দোলন আর নারী জাগরণের অগ্রদূত এই নারীর জন্মদিনে তার প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম। তার হাত ধরেই মুসলিম বাঙালি নারীদের সাহিত্য চর্চা আর ন্যায় সংগ্রামের সূচনা। তাঁর প্রেরণা চিরজাগরূক হোক লক্ষ-কোটি বাঙালির প্রাণে।
কবির শব্দ, ছন্দ আর সংগ্রামের স্মৃতি যেন ছড়িয়ে যায় কবিতার লহরে- কাল কভু চুপ নাহি রয়,কথা কয়, সে যে কথা কয়। সে আবার জেগে ওঠে প্রত্যহের জীবন-স্পন্দনে; সে দুর্বার প্রাণবেগে বেঁচে ওঠে নিত্যের স্মরণে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)