জন্মনিয়ন্ত্রণের সব দায়িত্ব নারীর উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশে নয়জন নারীর বিপরীতে মাত্র একজন পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। গত চার দশকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারী আটগুণ হয়েছে, আনুপাতিক হারে পুরুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে; কিন্তু শুরুতে যেভাবে নারীর উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হতো এখনো সেই প্রবণতাই চলছে। ১৯৭৫ সালে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতেন মাত্র আট শতাংশ দম্পতি, এখন তা ৬১ শতাংশের বেশি। তবে, তখন পদ্ধতি গ্রহণকারী প্রায় সকলেই যেমন ছিলেন নারী, এখনো তাই।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪২ বছর অাগে ০.৭ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করতেন, আর এখন ৬.৪ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করেন; এর বড় অংশই অবশ্য শহরে। একই সময়ে খাওয়ার বড়ি ব্যবহারকারী নারীর হার ২.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশে উঠেছে। এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণে পিলই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি। এছাড়া ১.৭ শতাংশ নারী স্বল্পমেয়াদী ইমপ্ল্যান্ট গ্রহণ করছেন ।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিশ্লেষণ বলছে, গ্রামাঞ্চলের নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে ডিএমপিএ (ইনজেকশন) পছন্দ করলেও শহুরে জীবনে জন্মনিয়ন্ত্রণে কনডম বেশি জনপ্রিয়।
১৯৯৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৪ সালে এই হার এক শতাংশেরও কম হারে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাইলে সামনের বছরগুলোতে প্রতিবছর ২.৭ শতাংশ হারে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২৭ লাখ। প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে ১৮ থেকে ২০ লাখ শিশু।
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সাফল্যে বর্তমানে প্রজনন হার ২.৩ এ নেমে এসেছে যা স্বাধীনতার পর ছিল ৬.৩। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি হারও কমে ১.৩৭ হয়েছে। কিন্তু, জনসংখ্যা বাড়ছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারে যারা আবার পরে শিক্ষিত হচ্ছে না; যে কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানবসম্পদ উন্নয়নে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ কাজী মোস্তফা সারোয়ার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র শ্রেণিতে এখনও জনসংখ্যা বাড়ছে আর শিক্ষিত শ্রেণিতে জনসংখ্যা কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দুই এর মধ্যে থাকলে ২০৫০ সালের পর আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বর্তমানে ১২ শতাংশ অপূর্ণ চাহিদাকে কমিয়ে ১০ শতাংশে আনার লক্ষ্যে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ হাতে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন: ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে সেখানে ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ প্রসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সেবা কেন্দ্রে সঠিকভাবে মায়েরা সন্তান প্রসব করার পর তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো হবে এবং এ বিষয়ে তখন তাদের কোন সংকোচ বোধ থাকবে না।
বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বিবেচনায় স্থায়ী থেকে ইমপ্ল্যান্ট (দীর্ঘ মেয়াদী) জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে দুর্গম অঞ্চল, চর এলাকাগুলোতে এখনও জনসংখ্যার মাত্রা বেশি। তাই ওই অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য রেখে মাঠপর্যায়ে কর্মীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তার সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবাগুলো নিশ্চত করবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তাদের জানাবে।
‘আশা করছি দুর্গম এলাকার জনসংখ্যা বাড়ার হার কমাতে সক্ষম হবো।’
শুধুই কি গ্রাম?
শুধু গ্রাম নয়, ঢাকা শহরে বস্তি বা ভাসমান অবস্থায় বসবাস করা জনগণের মধ্যেও জন্মনিয়ন্ত্রণ না থাকা সম্পর্কে ডাঃ কাজী মোস্তফা সারোয়ার বলেন: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিনিয়ত যে সমস্যায় পড়তে হয় সেটার মধ্যে এটিও একটি বিষয়।
তিনি বলেন: ঢাকা শহরে বস্তি বা ভাসমান মানুষদের নিয়ে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ ও নজর আরও বাড়াতে হবে। এখানে পরিবার পরিকল্পনার কোনো ইউনিট নেই। তবে খুব শিগগিরই সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করব এবং আমাদের মাঠকর্মী নিয়োগ করব।
পুরুষদের নিয়ে কী পরিকল্পনা?
এখনও বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে নারীদের প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয়। সেক্ষেত্রে পুরুষদের নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নতুন কোন পরিকল্পনা আছে?
জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন: দেশটা এখনও পুরুষশাসিত সমাজ। পুরুষরা এ ব্যাপারে নারীদের আগে ঠেলে দেয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আরেকটি হলো জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ পদ্ধতিগুলো নারীদের জন্য। পুরুষদের জন্য মাত্র দু’টি পদ্ধতি রয়েছে: একটি কনডম, অন্যটি স্থায়ী পদ্ধতি এনএসভি।
এরপরও পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য যেসব পুরুষ এনএসভি পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তাদের দিয়ে মাঠ পর্যায়ে ক্যাম্পেইন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন: তারা অন্য পুরুষদের এ পদ্ধতি সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করে। তাছাড়া বিজ্ঞানসম্মতভাবে নতুন করে পুরুষদের জন্য আর কোনো পদ্ধতি আনা সম্ভব নয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন?
পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণে কেন বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে? চ্যানেল আই অনলাইন এ বিষয়ে কথা বলেছে পুষ্টি ও জনসংখ্যা নিয়ে দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি বিষয়ক পরিচালক কাওসার আফসানার সঙ্গে।
তিনি বলেন: প্রত্যন্ত অঞ্চলেগুলোতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রভাব একেবারেই পড়েনি। ওই এলাকাগুলোতে সরকারি, বেসরকারি এবং এনজিওদের কাজ খুবই অপ্রতুল। অঞ্চলভেদেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে যেমন সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলগুলো এখনো নিয়ন্ত্রণের মাত্রা অনেক কম। হাওর ও চর এলাকার মানুষ খুব দরিদ্র হওয়ায় পুষ্টিহীনতায় বেশিরভাগ সন্তান মারা যায় সেকারণে নারীরা বেশি সন্তান নেন।
‘শুধু পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেই হবে না, তাদের শিক্ষিত, উন্নত করতে হবে। তাহলে ওইসব অঞ্চলের জনসংখ্যা কমানো যাবে।’
তিনি একথাও বলেন: পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা আগে যেভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী ও পুরুষদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজ করতেন সেই কাজগুলো আগের মতো ঠিক হয় না। আমাদের সময়ে বাংলাদেশে টেলিভিশনে পরিবার পরিকল্পনার ওপরে এতো সুন্দর অনুষ্ঠান দেখানো হতো যে গ্রামীণ নারীরা সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য বসে থাকত ও উপকৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই অনুষ্ঠাগুলো এখন আর চোখে পড়ে না।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে পুরুষদের কেন এতো অনীহা?
কাওসার আফসানা বললেন: পুরুষরা এখনও লজ্জা পায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে। এমনকি ভয়ও পায়। অন্যদিকে স্বামীর যাতে তথাকথিত কোনরকম শারীরিক সমস্যা না হয় তাই স্ত্রীও চায় না।
‘এই ভীতিগুলো সরাতে হলে প্রথমত মাঠ পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনার পুরুষ কর্মী দরকার,’ জানিয়ে কারণ হিসেবে তিনি বলেন: নারী কর্মীদের সঙ্গে পুরুষরা কথা বলতে এক প্রকার অনীহা বোধ করে।
পুরুষরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করবে সেটাকে পুরুষরা হাস্যকরও মনে করে উল্লেখ করে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কাওসার আফসানা বলেন: মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতায় অনেক পড়তে হয়েছে। পরিবার সুখী করতে এবং স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনেক পুরুষ চান জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে, কিন্তু বন্ধুরা ও আশপাশের মানুষরা হাসাহাসি করবে বলে তারা তা করতে চায় না।
একসময় পরিবার পরিল্পনার কিছু প্রোগ্রামে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে প্রচুর পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। তবে গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরে শিক্ষিত পুরুষরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করে বলে জানান তিনি।সেখান থেকে এখন বের হয়ে আসতে হলে পুরুষ কর্মীদের নিজেদেরই সেলিব্রেটি হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, আমি যদি এই পদ্ধতি গ্রহণ না করে আরেকজনকে বোঝাতে যাই তাহলে কাজটি কখনোই হবে না। সেক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে পুরুষ কর্মীদের নিজে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে অন্য পুরুষদের বোঝাতে হবে এর উপকারিতা ও ভালো দিকগুলো। তাহলেই সমাজে অনেক প্রভাব ফেলবে।
তাহলে কি পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড বিফল?
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর অনেক প্রচারণামূলক কাজ করার পরও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ হিসেবে তিনি বললেন: পরিবার পরিকল্পনা কী? কীভাবে কী করতে হয়? ব্যাপারগুলো জনগণ জানে ও বোঝে তাই এ বিষয়গুলোকে ডাল-ভাত ভাবছে, হয়তো সমস্যাগুলো তাই রয়েই গেছে।
‘সেক্ষেত্রে সরকারকে নতুন করে নিজে থেকে চিন্তা ভাবনা করতে হবে,’ জানিয়ে তিনি বলেন: স্বাস্থ্য মন্ত্রলণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর তুলনা করতে গেলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অনেক কর্মকাণ্ড রয়েছে কিন্তু তাদের কোনো উচ্ছ্বাস নেই। উচ্ছ্বাস না থাকলে কাজের গতি কখনোই বাড়বে না।
ভোটও কি জনসংখ্যা বাড়ার একটা কারণ?
কাওসার আফসানা বলেন: স্বাধীনতার পর সবার একটি উদ্দেশ্যে ছিল: দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা। বাংলাদেশের কোন সরকারই চাইবে না ভোটের জন্য তার দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাক।
‘বরং ভোটের জন্য সরকার আরও জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়।’
মেয়েদের কর্মসংস্থান এক সমাধান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে মায়েদের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: গার্মেন্টস সেক্টরে আগের তুলনায় নারীদের সন্তান নেওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। কারণ বাচ্চা জন্ম দেওয়া ও বড় করার যে সময় দরকার সেটি তাদের এখন নেই। তাই মেয়েদের কর্মসংস্থান বাড়লে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এক জায়গায় চলে আসায় পরিবার পরিকল্পনার খাতগুলোর মনোযোগ কমে গেছে মনে করছেন তিনি। সে কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীতে হঠ্যৎ মাতৃহার বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনাকে অবশ্যই আলাদাভাবে চাপ দিতে হবে।
তিনি বলেন: সব এলাকায় কিন্তু একইভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে না। বিশেষ করে চর এলাকা, হাওর এলাকা, নদী এলাকা যেখানে পড়াশুনার সুযোগ-সুবিধা কম, উন্নয়নের ছোঁয়া তেমনভাবে পৌঁছায়নি সেসব এলাকায় পরিবার পরিকল্পনায় নিয়ে বেশি কাজ করতে হবে।
‘শুধু নারী নয়, পুরুষদেরও জন্মনিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।’