শেষ হলো ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। পোষ্টার আর নির্বাচনী প্রচারণাতে দলের নেতা কর্মীদের সরগরম উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। তবে প্রচারণার সেই আমেজ প্রভাব ফেলেনি ভোটারদের মাঝে। তাই ভোট কেন্দ্র ছিল অনেকটাই ভোটারবিহীন।
একটা সময় ভোটের লড়াইয়ের চূড়ান্ত চিত্র দেখা যেত ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে। মানুষের ভোট দিতে আসার আগ্রহেরও কমতি ছিল না। ভোট প্রার্থীরা নানা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করত ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনা নেয়া করার জন্য। এর পাশাপাশি নানা ধরনের সংঘাত, ভোট কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনা আগে অনেক বেশি পরিমাণ ছিল। বর্তমানে তা কমে এসেছে। একই সাথে জনগণের রাজনীতির প্রতি অনীহার কারণে ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে।
তবে এ বিষয়টিকে খুব সাদামাটাভাবে দেখার অবকাশ নেই। তার কারণ হলো ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিকভাবে দেশে আমূল পরিবর্তন আসে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক অবস্থান ২০০৯ থেকে বর্তমান অবধি। দেশের আরেক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে। রাজনীতির মাঠে তাদের দাঁড়াবার মতো অবস্থা নেই নেতৃত্ব সংকটসহ মামলা হামলার কারণে। যার ফলে কর্মী, সমর্থকরা নীরব ভূমিকা পালন করছে।
অন্য দিকে দীর্ঘ সময় ধরে এককভাবে সরকার পরিচালনাতে আওয়ামী লীগ। যার কারণে মনে করা হয়, ভোটের জয় পরাজয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশ পাবে না। এছাড়া ধারণা করা হয়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে ভোট ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণাধীন। এমন ধারণার পেছনে অতীতের বিতর্কিত ভোট বিশেষভাবে প্রভাব ফেলছে৷ ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য বাংলাদেশের ভোটে নতুন কোন ঘটনা নয়। যদি ও বলা হয় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এটি গণতান্ত্রিকভাবে তার নিজের মতো করে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। তাহলে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, দেশের সকল ধরনের নির্বাচনে জনগণের উপস্থিতির হার কমের দায় ভার কার? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব নাকি নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের ত্রুটি।
আওয়ামী সরকারের আমলে যে কোন নির্বাচন আসার আগেই বলা হয়ে থাকে, ভোট দিয়ে কী হবে? জিতবে নৌকা। যা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকালীন সময়েও শোনা গেছে। যদি ধরে নেয়া হয়, আওয়ামী লীগ ছাড়া এখন আর কোন দল নেই; তাহলে এ নির্বাচনে দলের সমর্থনকারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ না করে নিজের দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সঠিক হয়নি।
গণমাধ্যমের তথ্যমতে, দক্ষিণে মোট ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ভোটারের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ ভোট দিয়েছে। উত্তরে ভোটের হার আরও কম ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ভোটের এ হার থেকে জনগণের ম্যান্ডেট সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়নি তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
ভোট দেয়া নাগরিকের যেমন অধিকার তেমন দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনীহা, সরকার দলের আধিপত্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের জটিলতা বিশেষ কারণ। জাতীয় পরিচয়পত্রের বর্তমান ঠিকানাই একজন ভোটারের ভোটধিকার প্রয়োগের জন্য প্রযোজ্য হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় বর্তমান ঠিকানা পরির্বতন হবার কারণে অধিকাংশ মানুষ তার নির্ধারিত এলাকায় ভোট দিতে যায় না। যদিও এ দেশে কারো ভোট নষ্ট হয় না বলে প্রবাদ রয়েছে। তথাপি এ বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। পোষ্টাল ভোট, বর্তমান ঠিকানা পরিবর্তনের বিষয়কে আরও আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি ভোট দানে উৎসাহিত করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকার সমন্বয় করা সময়ের দাবি।
নির্বাচনের জয় পরাজয় রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের বিশেষ ও সর্বোচ্চ মাধ্যম গণতান্ত্রিক ভাবে। তাই একটি দেশের জনগণ নির্বাচন থেকে ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিলে তা জাতীয়ভাবে হিতকর হবে না।
বিজয়ের ফুলেল শুভেচ্ছাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই নগর সেবক আপ্লুত। তবে ঢাকাবাসীর ভোট দানের হার বিজয়ের আনন্দ কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে রাজনৈতিক অংক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)