এ এক দুর্লভ ঘটনা। লেখিকার পরিচয় বললে বলতে হয় গৃহপরিচারিকা। আমাদের দেশে বাসাবাড়িতে যারা কাজ করে তাদেরকে তো গৃহকর্মীই বলা হয়। কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া বেবীদের সংসারে নিত্য অভাব-অনটন-অবহেলা,স্বামীর নির্যাতন। মদ্যপ বাপের বাড়ীতেও কেটেছে একইরকম পরিবেশে। সংসার সমন্ধে উদসীন বাবা, অভাব-অনটন, মায়ের উপর নির্যাতন। নিরুপায় মা বাধ্য হয়ে একসময় কোলের সন্তানকে নিয়ে করে গৃহত্যাগ। বেবীর বয়স তখন মাত্র চার। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কাশ্মীর থেকে ফিরে এসে বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন সংসার বাঁধেন পশ্চিম বাংলার দুর্গাপুরে। সৎ মা সিক্সে পড়া বেবীর বিয়ে দেন দ্বিগুন বয়সী ডেকরেটর দোকানের কর্মচারির সঙ্গে। বছর না ঘুরতেই সন্তান, পিঠোপিঠি আরো দু’জন। সংসারে নিত্য অভাব-অনটন,স্বামীর চরম অবহেলা ও নির্যাতন।
মায়ের মতই বেবীও একদিন সংসার ছাড়ে। তার সঙ্গে তিন-তিনটে সন্তান। দুর্গাপুর থেকে উঠে পড়ে দিল্লীগামী রাতের ট্রেনে। একসময় দিল্লী পৌঁছায়। কিন্তু তার হাতের এক টুকরো কাগজে লেখা ঠিকানা তো দিল্লী না। স্টেশনেই জিজ্ঞাসা করে প্লাটফর্ম বদল করে পৌছায় ফরিদাবাদ এবং একসময় ঠিকানার বস্তিতে। ভাইয়ের আশ্রয় না পেলেও সহানুভুতি এবং পরামর্শ পায় এক হিন্দি ও পাঞ্জাবী বধুর কাছ থেকে। বেবী, পুরো নাম বেবী হালদার আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে গৃহকর্মি বা কাজের মেয়ে। কিন্তু প্রতিপদে অপমান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা,কুপ্রস্তাবও আসে। কারণ তার বয়স পঁচিশ, মাথার উপর স্বামী বা অভিভাবক নেই, সঙ্গে তিন তিনটে ছেলে-মেয়ে। নিজে নিজেই কাজ খোজে, পায়, আগেরটা ছাড়ে, নতুন যায়গায় যোগ দেয়। বড় ছেলেকেও কাজে দেয়। বেবী এভাবে ফরিদাবাদ থেকে আসে দিল্লীর গুরগাঁওয়ে। বিধাতা তার দিকে মুখ তুলে চায়। প্রৌঢ় গৃহকর্তা হয়ে ওঠেন ভাতুস (বাবা)। তিনি দেখেন এ মেয়ের কাজে-কর্মে ভালো, আলমারীর বই ঝারমোছ করতে যেয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, সে ক্লাস সেভেনে উঠেছিল, বই পড়তে তার ভালো লাগে। গৃহকর্তা তাকে অনুমতি দেন অবসরে আলমারী থেকে বই নিয়ে পড়বার। একদিন উপহার দেন তসলিমা নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’। এই বই পড়তে যেয়ে সে চমকে ওঠে, তারও তো মেয়েবেলা আছে, আছে ছেলেবেলা, তা সে যত কষ্টেরই হোক!
একদিন একটি ডায়েরি ও কলম দিয়ে ভাতুস তাকে লিখতে বলেন। সে কেঁপে ওঠে, সে কী লিখবে? তখন তার মনে পড়ে ‘আমার মেয়েবেলা’র কথা। ভয়ে ভয়ে লিখতে শুরু করে তার ছেলেবেলার কথা।
‘…আমরা ছিলাম জম্মু-কাশ্মীরের কোন এক যায়গায়।…ওখানকার যায়গা ভারি সুন্দর, কত বড় বড় পাহাড়! পাহাড়ে কত রকম ফুল। খুব সুন্দর দেখায়। তখন আমার বয়স চার বছর। ওখান থেকে আমার বাবা আমাদের নিয়ে এল মুর্শিদাবাদ। ওখানে কিছুদিন থেকে আবার নিয়ে এলো ডালহৌসি। সেখানকার যায়গাও জম্মু-কাশ্মীরের মত। ওখানে আকাশ থেকে মৌমছির মত ঊড়ে উড়ে বরফ মাটিতে পড়ে জমে যায়…’।
প্রথম দিকে লেখা এগোয় না, বানান ভুল, বাক্য ঠিকমত হয় না। তবু বেবী লিখে চলে, তার মদ্যপ বাবার সংসার সমন্ধে চরম উদাসীনতা, অভাব-অনটন, মায়ের উপর নির্যাতন। নিরুপায় মা একসময় কোলের সন্তানকে নিয়ে করে গৃহত্যাগ। সে লেখে তার বারো বছরে বিয়ে, তেরো বছরে প্রথম সন্তান, পিঠোপিঠি আরো দু’জন।
একদিন ভাতুস জানতে চায় বেবী কী লিখেছে। সে ভয়ে ও সঙ্কোচে ডায়েরীটি এগিয়ে দেয়। একশ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে ততদিনে। পড়তে যেয়ে ভাতুস কেঁদে ফেলেন। বেবীকে বলেন, ভগবান তোমাকে লেখার জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তুমি লিখে যাও।
এই ভাতুস সত্যিই হয়ে ওঠেন তার বাবা। দ্বিতীয় জন্ম হয় বেবীর। এই ভাতুস হচ্ছেন হিন্দি সাহিত্যের দিকপাল মুনশী প্রেমচাঁদ (মূল নাম ধনপত রাই শ্রীবাস্তব, তার উপন্যাস ‘সতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিত রায়)-এর নাতি। নাম প্রবোধকুমার, নৃবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি তাঁর বন্ধুদের পড়তে দেন বেবীর পাণ্ডুলিপি। তারা বলেন, এ তো আনা ফ্রাঙ্কের মত লেখা।
প্রবোধবাবু হিন্দিতে ট্রান্সলেট করেন বেবীর লেখা। তার চেষ্টাতেই কোলকাতা থেকে বের হয় হিন্দি ‘আলো-আন্ধারী’, ২০০২ সালে। প্রকাশেই পাঠক সমাদর। পত্র-পত্রিকা মিডিয়া কাভারেজ। একাধিক সংস্করণ বের হয়। ২০০৩ এ বের হয় মূল বাংলা ‘আলো-আঁধারি’, দ্রুতই বের হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ। বের হয় মালায়লাম ভাষায়ও।
উর্বশী বুটালিয়া কর্তক ইংরাজিতে অনূদিত হয়ে A Life Less Ordinary: A memoir নামে প্রকাশিত হয়। ভারতে হয় বেস্ট সেলার। পত্র-পত্রিকায় যথেস্ট প্রশংসিত হয়। The New York Times লেখে India’s Angela’s Ashes ।[Angela’s Ashes হচ্ছে আইরিশ- আমেরিকান লেখক Frank McCourt এর ১৯৯৯ সালের পুলিতজার পুরষ্কার বিজয়ী আত্মজীবনী গ্রন্থ যেখানে লেখক লিমেরিক-আয়ারল্যান্ডে তার মদ্যপ পিতার অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠার কাহিনী বর্ননা করেছেন।]
২০০৮ সালে ‘আলো-আঁধারি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। প্রকাশক দিল্লীর প্রীতি গীল বেবী হালদারকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানী সফরে যান। ফ্রাঙ্কফুর্ট, ডুসেলডর্ফ, ক্রেফিল্ড, হালে, কিয়েল, বার্লিন, হাইডেলবার্গে সেমিনার করেন। বেবী বলে ভারতে তার মত নারীদের কথা। জার্মানীতেও বইটি বেস্টসেলার।
নয়টি আঞ্চলিক এবং বারোটি বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘আলো-আঁধারি’।
বেবী হালদারের প্রথম বই ‘আলো-আঁধারি’ বের হওয়ার (২০০২) পর দ্বিতীয় বই ‘ঈষৎ রূপান্তর’ বের হয় ২০১০ সালে, তৃতীয় বই ‘ঘরে ফেরার পথে’ ২০১৪ সাল। তার বইয়ের প্রকাশক রোশনাই প্রকাশন তিনটি বইকে দুই মলাটের মধ্যে একত্রে করে বের করেছেন ‘কবে আমি বাহির হলেম’।
বেবী হালদার তার সম্মানীর অর্থে কোলকাতায় একটি বাড়ী করেছেন। এখন সেখানে বাস করছেন ছেলে তাপস ও মেয়ে পিয়াকে নিয়ে। বড় ছেলে সুবোধ দিল্লীতে বাস করছে পরিবার নিয়ে।
সত্যি এ এক দুর্লভ ঘটনাই। ক্লাস সিক্স পর্য্যন্ত সামান্য পড়াশোনা, পিতা ও স্বামীর অভাব-অনটন-অবহেলার দীর্ঘ দিনের সংসার অবলিলায় পেছনে ফেলে রেখে স্বাবলম্বী হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় অচেনা-অজানার উদ্দেশে দিল্লীতে এসে গৃহকর্মির কাজে নতুন জীবন শুরু, প্রতিপদে অপমান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে একজন ভাতুসের সয়ায়তায় লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ এক দুর্লভ ঘটনাই। দেশে-বিদেশে একজন জনপ্রিয় লেখিকার পরেচিতি পেয়েও বেবী হালদার এখনো নিজেকে পরিচয় দেন গৃহকর্মী হিসাবে।