সম্প্রতি সাভার ও ঝালকাঠি জেলায় দুজন ধর্ষণ মামলার আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় যাদের গলায় তাদের পরিচয় এবং ধর্ষণের বিষয়টি চিরকুটসহ গলায় ঝোলানো ছিল। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে কারা করছে এসব হত্যাকাণ্ড?
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ধরণের হত্যাকাণ্ড গুরুতর অপরাধ, এটাকে অপমৃত্যু বলা যায়। যারা এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে আইন ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দেশে ধর্ষণকারীদের বিচার নেই বললেই চলে, কেউ হয়তো এরকম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে একটি দৃষ্টান্তমূলক বার্তা দিতে চাইছে যা সমাজের জন্য ইতিবাচক। তবে হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি তারা আমলে নিয়েছেন। খুব দ্রুতই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে।
গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার আশুলিয়ায় এক কিশোরী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি রিপনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর ৯ দিন পর ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে পাশের জেলা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি ছিল।
সাভারে নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূলহোতা।’ অপরদিকে ঝালকাঠিতে নিহত সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি রহিমার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’
রিপনের পরিবারের দাবি, সাদা পোশাকধারী কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তবে গোয়েন্দা পুলিশ এ দাবি নাকচ করে দেয়।
রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কারখানা ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে ওই নারীর গতিরোধ করে স্থানীয় রহিম, শিপন ও কারখানার লাইনচিফ রিপনসহ পাঁচ বখাটে। এরপর তারা ওই নারীকে ধর্ষণ করে। এর একদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারী মারা যায়। পরে ৭ জানুয়ারি এ ঘটনায় রিপনের নামে মামলা দায়ের করা হয়।
ঝালকাঠিতে নিহত সজলের অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়, গত ১২ জানুয়ারি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। নিজ বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যাওয়ার পথে ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ অভিযোগে সজলকে প্রধান আসামি করে গত ১৪ জানুয়ারি ভান্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়। মামলা হওয়ার পর সজল ঢাকায় পালিয়ে আসে। এরপর মধ্য বাড্ডায় শ্বশুরের বাসায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে ১৫ জানুয়ারি রাকিব নামের একজন তাকে ডেকে নিয়ে যায়, পরে ঝালকাঠিতে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কাউকে হত্যা করা সবচেয়ে বড় অপরাধ, যারা এ ধরণের অপরাধ করছে তাদের খুঁজে বের করে প্রচলিত আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, কোন ধরণের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুই কাম্য নয়, এই দুটি মৃত্যু স্বাভাবিক নয় অপমৃত্যুও বলা যেতে পারে, এগুলো কাম্য নয়। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
মানাবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেও বিষয়টিকে সমাজের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর ধর্ষণের ঘটনা অসম্ভবভাবে বেড়ে গিয়েছে। কর্মস্থল থেকে শুরু করে বাসে রাস্তায় বাসায় কোথাও কোনো বয়সের নারী নিরাপদ না, দুই থেকে শুরু নয় বছরের বাচ্চা পর্যেন্ত আমাদের সমাজের ধর্ষিত হয়। যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেটা তালিকাভুক্ত হয় না। যে পরিমাণ ধর্ষণের আসামি থাকে তাদের দশ ভাগের বিচার হয় আর নব্বই ভাগের বিচার হয় না।
রাষ্ট্রের ভেতর কোনো হত্যাকাণ্ড হলে তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। যারা এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করছে তারা একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে যা সমাজের জন্য খুবই ইতিবাচক। হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য না। কিন্তু বিচার না হওয়ার জন্য তারা ধর্ষকদের এমন বার্তা দিতে চাইছে যে ধর্ষণ যদি করো তাহলে পরিণতিটা নির্মম হত্যাকাণ্ডেই হবে।
এমন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এ ঘটনা দুটির সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন যা প্রকৃত সত্য তুলে আনবে। আমাদের সংবিধান ও মানবাধিকারের মূলনীতি অনুযায়ী যে কোনো মানুষই আইনানুগ উপায়ে বিচার লাভের অধিকার রাখে। এ ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমাজে ভুল বার্তা প্রদান করে। আশা করছি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে খতিয়ে দেখবে এবং অপরাধের আইনানুগ শাস্তি প্রদান করবে।
এমন হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) মো. সোহেল রানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বিষয়টি ইতিমধ্যেই আমরা আমলে নিয়েছি, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা আইনের চোখে অপরাধী।তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।