এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।
শামসুর রাহমানের এই কবিতার মতোই যেনো কদিন পরপর গুজবে কান পেতে অস্থির হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। পেয়াজের গুজবে কিছুটা সত্যতা থাকলেও সেই সুযোগে ছড়িয়ে দেয়া হলো লবণের গুজব। গুজবে বিশ্বাস করে সরলমতি মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে। প্রতিদিন মাত্র অল্প পরিমাণ প্রয়োজনীয় লবণের কেজি কোথাও কোথাও বিক্রি হয় ১০০ টাকার বেশি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিতে তৎপর হয়। বাংলাদেশে গুজব যেনো দ্রুত ডালপালা ছড়ায়। কানের স্থানে কান আছে কিনা না দেখে চিলের পিছে ছুটে বেড়ানার পালে হাওয়া লাগিয়েছে হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
পূর্বে মানুষ সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের খবরকে বিশ্বাস করতো। এখন যেনো নতুন বিশ্বাসের স্থান হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
গুজবের ইতিহাস
১৬০০ সালে জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। রোমের খ্রিস্টান আদালতে তার বিচার করে পোপ ৮ম ক্লামেন্ট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পৃথিবী,সূর্য, মহাবিশ্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য বলেছিলেন। তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় তিনি ঈশ্বরের সৃষ্টির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গুজব ছড়ানো হয় , পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসলাম রক্ষায় তাই পাকিস্তানের পক্ষে লড়তে হবে।
২০১৩ সালের ৫মে মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু কিশোররা জানতো না নাস্তিকরা কি বলেছে? কিন্তু তাদের কাছে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। দলবেধে তারা শাপলা চত্বরে জমায়েত হয় ইসলাম রক্ষায়!
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামাত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হয়। চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয় সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। অনেকে তাদের মনের সাঈদীকে চাঁদে দেখতে পেয়ে ঐ দুই এলাকার থানা, কোর্ট কাচারি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কি অদ্ভুত? একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মান্ধ মানুষ কতটা অন্ধ হলে একজন ব্যক্তিকে চাঁদে দেখার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী করতে পারে।
পদ্মা সেতু শিশুর মাথা চাচ্ছে তাই শিশু ধরার গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। মানুষ বিশ্বাস করে স্কুলে শিক্ষার্থী পাঠানো বন্ধও রেখেছিলো।
বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি। তৎকালীন জাসদের নেতা-কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে গণকন্ঠের মাধ্যমে এই গুজব ছড়ায়। কোন ব্যাংক কখন লুট হয় তার কোন তথ্য ছাড়ায় এই গুজব ছড়ানো হয়।
১৯৪৩ সালের চাল সংকটের গুজব ছড়িয়ে দুর্ভিক্ষকে ত্বরান্বিত করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশে এই ধরনের গুজবের গল্প অসংখ্য।
গুজবের শক্তি
গুজবের সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন রবার্ট এইচ নাপ। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তার বই “সাইকোলজি অব রিউমার’’। গবেষক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বকালীন গুজবকে বিশ্লেষণ করে একে তিনভাগে ভাগ করেছেন।
ক. পিপ ড্রিম রিউমার: এটি সাধারণত জনগণের মনের দৃঢমূল ধারণাকে পূজি করে হয়( যেমন: পেয়াজের সংকট হয়েছে, তাই লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানো।
খ. ভগি বা ফিয়ার রিউমার: এটি সাধারণত জনগণের ভয় থেকে হয়। (যেমন: আল্লাহ্ ভীতিকে কাজে লাগিয়ে অন্ধ বিশ্বাসীদের সাঈদীকে চাঁদে দেখানো। কারণ সাঈদী আল্লাহর গুনকির্ত্তন করে ওয়াজ করেন।
গ, রিউমার অন বিলিভ: বিশ্বাসকে ভিত্তি করে গুজব। যেমন: ৫মে শাপলা চত্ত্বরে ইসলাম বিশ্বাসী শিশু কিশোরকে জড়ো করে ইসলাম বিপন্নের কথা বলে।
বাংলাদেশে মানুষ সাধারণত প্রচণ্ড বিশ্বাসপ্রবণ। ধারণাপ্রসুত কথা বলার প্রবণতা শক্তিশালী। যেকোন বড় মানুষ সম্পর্কে হরহামেশা শোনা কথা ছড়িয়ে দেয়া হয়। যদিও এখানে প্রবাদ আছে,‘শোনা কথায় কান দিতে নেই।’
বিশ্বাসপ্রবণ এবং ধারণাপ্রসুত কথা বলার প্রবণতা যে অঞ্চলে যত বেশি গুজব কার্যকর সেখানে তত বেশি হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার হারের কারণে কোন গুজব হলেই তারা অস্থির না হয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তারা তথ্য নিশ্চিত হয়।
গুজবে ভক্তি বাড়ার সাম্প্রতিক প্রবনতার কারণ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে গুজবে জনগণের ভক্তি বাড়ার লক্ষন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ কি। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০এর অধিক টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রও রয়েছে। তারপরও মানুষ কেনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যকে গণমাধ্যমের চেয়ে বেশি সত্য মনে করছে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রচলিত গণমাধ্যমের উপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে। নির্বাচনসহ বেশ কিছু ঘটনায় মানুষ তার চোখের সম্মুখে ঘটা তথ্যের বিকৃতি দেখেছেন গণমাধ্যমে। ফলে গণমাধ্যমের তথ্যের উপর মানুষের বিশ্বাস হারিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের সহজ তথ্য পাওয়ার মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্ভরতা বাড়ে। ব্রিটিশ আমলে সরকার যখন স্বাধীন গণমাধ্যমকে রুদ্ধ করার জন্য সেডিশন বিল পাস করে তখন রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধীতা করে টাউন হলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন, সংবাদপত্রকে তথ্য প্রকাশে বাধা দেয়া হলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীন সেখানে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
তাই গুজব প্রতিরোধে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ এবং গণমাধ্যমের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরী। নিজের সমালোচনাকে ভয় না পেয়ে তাকে ভুল খুঁজে পাওয়ার উপায় হিসেবে বিবেচনা করলে আখেরে সরকারেরই লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)