গণহত্যাকারী আজহারের ফাঁসির অপেক্ষায় দেশ

এ পর্যন্ত বিচার হওয়া অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের চেয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম একটি জায়গাতে বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। সেটি হলো ধর্ষণ। এর আগে এভাবে সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগ শুধুমাত্র বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধেই উত্থাপিত হয়েছিল।

প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে আজহারের দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়ে উঠতি বয়সেই সে হয়ে উঠেছিলো রংপুর অঞ্চলের ত্রাস। জামায়াতের আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম একাত্তরে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি।

যে সময়ে তাঁর সমবয়েসীরা মাতৃভূমির শৃংখল মোচনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গণে, সেসময় আজহার ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্র শিবির) কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলে ৭০ সদস্যের আলবদর বাহিনী। তার নেতৃত্বেই বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, বহু নারীকে ধর্ষণ ও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিলো বলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের তত্ত্বাবধানে আল বদর নামের সশস্ত্র দলটি গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী সে সময় রংপুর টাউন হলকে নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে এবং বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হয়। আজহার ও তার খুনিবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দিত এবং তাদের হত্যা, আটকে রেখে নির্যাতনে অংশ নিত।

এমনকি সে যে কলেজের ছাত্র ছিলো সেই রংপুরের কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে নৃশংস অত্যাচার শেষে হত্যা করে। তাদের অপরাধ, তাঁরা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ ছিলেন।

যুদ্ধের ৯ মাস ধরে রংপুরের আনাচেকানাচ থেকে নারী থেকে শুরু করে কিশোরীদের পর্যন্ত ধরে ধরে “প্যায়ারে পাকিস্তানের খেদমতে” পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিতো সে। নিজেও অংশ নিতো পাশবিক নির্যাতনে।

আজহারের নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়, তার দ্বারা নির্যাতনের শিকার রংপুরের বীরাঙ্গনা মানসুরার সাক্ষী থেকে, যাকে অন্য অনেক নারীর মতো ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজহার ও পাকিস্তানি বাহিনী। রংপুর টাউন হলে নিয়ে করা হয়েছিল বর্বর নির্যাতন।

ট্রাইব্যুনালে আজাহারের ফাঁসির রায় শুনে তিনি বলেছিলেন, “লম্পট আজহারের ফাঁসির রায় হওয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ফাঁসি কার্যকর হলে শান্তিতে মরতে পারব।”

প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বর অভিযোগে ১৪ জনকে অপহরণের পর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগে ঝাড়ুয়ার বিল ও দমদম ব্রিজে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শ’র বেশি লোককে হত্যার দায়ে আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ের পর প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, “ট্রাইব্যুনালে যতগুলো বড় গণহত্যার ঘটনার বিচার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যা। সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে হয়নি।”

আজহারের নৃশংস নারী নির্যাতনের ব্যাপারে মাননীয় রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। যাতে বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, পাকিস্তান দখলদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর ও আল শামসের যৌন সন্ত্রাসসহ বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তারা জানতে পারে।”

রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশন বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণের আবেদন জানালেও ট্রাইব্যুনাল আইনে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।

“কিন্তু আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিৎ আর দেরি না করে এই বীরাঙ্গনাসহ সকল বীরাঙ্গনাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা। কারণ তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা। সমাজে তাদেরকে গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও জাতির অহঙ্কার।”

১৬ই ডিসেম্বরের পরে আজহার পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান। ৭৫ সালে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে দেশে ফিরে আসেন। ৭৮ সালে জিয়াউর রহমান জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ ফিরিয়ে দিলে, আবারো তাতে তৎপর হয়ে ওঠেন। পালন করে ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমীর আর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্বও।

২০১২ সালে ২২ অগাস্ট তাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারে এই ঘাতক নরপশুর অপরাধ সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। এখন বাদবাকি আইনী লড়াইয়ের সমাপনীর অপেক্ষা।

১৪’শ নিরীহ মুক্তিকামী বাঙ্গালী আর অসংখ্য সম্ভ্রম হারানো বীরাঙ্গনা মায়েদের ৪৫ বছরের চাতক প্রতীক্ষার অবসান প্রত্যাশায় রইলাম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

এটিএম আজহারুল ইসলামমানবতাবিরোধী অপরাধযুদ্ধাপরাধীর বিচার