নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে গণমাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তারপরও অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছি, সম্প্রতি দেশের একাধিক গণমাধ্যম নির্যাতিত নারী-শিশুর ছবি, এমনকি তার নাম-ঠিকানা ও পরিচয় হরহামেশাই প্রকাশ করছে!
যে গণমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, সেই গণমাধ্যম কি এভাবে আইন অমান্য করতে পারে? এমনকি বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উচ্চ আদালত দৃষ্টিআকর্ষণও করেছেন, এতকিছুর পরও গণমাধ্যমের এমন কর্মকাণ্ড কারোরই কাম্য নয়।
সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের বিষয়ে আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা হয়েছে: ‘‘এ আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হয়েছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে, যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।’’
এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হওয়া যে নারী শিশুর পরিচয় প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না সেগুলো হচ্ছে:
*দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা মৃত্যু ঘটানো হয়েছে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে এমন নারী বা শিশু।
*দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ কোন শিশু বা নারীর উপর নিক্ষেপ করা হয়েছে বা নিক্ষেপ করার চেষ্টা করা হয়েছে এমন শিশু বা নারী।
*আহত শিশু বা নারী যার দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়েছে বা শরীরের কোন অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃত বা নষ্ট হয়েছে বা শরীরের অন্য কোন স্থান আহত হয়েছে এমন শিশু বা নারী।
*দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি নষ্ট বা মুখমণ্ডল, স্তন বা যৌনাঙ্গ বিকৃত বা নষ্ট হয়েছে এমন শিশু বা নারী।
*অপহৃত নারী বা শিশু, মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে আটক শিশু ও নারী, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু, ধর্ষণের কারণে আহত বা বা মৃত্যু হয় এমন শিশু ও নারী।
*সম্ভ্রমহানী হয়েছে, আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা হয়েছে, এমন নারী। এবং শ্লীলতাহানীর শিকার নারী বা শিশু।
*যৌতুকের কারণে মৃত্যু হয়েছে বা হত্যার চেষ্টা হয়েছে এমন নারী
*ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে কোন শিশুর হাত, পা, চোখ, বা অন্য কোন অঙ্গ বিনষ্ট করা হয়েছে বা অন্য কোনভাবে বিকলাঙ্গ বা বিকৃত করা হয়েছে এমন শিশু
*ধর্ষণের ফলে জন্ম হয়েছে এমন শিশু।
নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে এই বিধি-নিষেধ লংঘন করা হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন বলে এ আইনে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।
অনেকেরই হয়ত মনে আছে, ২০০২ সালের ৪ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় নির্যাতিত এক নারীর পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হয়। এরপর জনকণ্ঠ সম্পাদক সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন ওই নারী। ২০০২ সালের ১৯ জুন ওই মামলায় জনকণ্ঠের সম্পাদক, উপদেষ্টা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন বিচারিক আদালত। তবে ২০০৩ সালে মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করনে জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ অন্যরা। কিন্তু বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসানের অবকাশকালীন বেঞ্চ ২০১৮ সালে মামলা বাতিলের আবেদন খারিজ করে দেন। ওই রায়ের ফলে সেই মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে বিচারাধীন।
নাবালিকা বা শিশু ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অস্পষ্ট ছবিও ব্যবহার করা যাবে না বলে গত ২ আগস্ট রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷ সে রায়ে আদালত বলেছেন, অস্পষ্ট ছবি দিলেও তাতে নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
তাই সার্বিক বিবেচনায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা থেকে আমাদের গণমাধ্যমকে বিরত থাকতে হবে। এক্ষত্রে মনে রাখতে হবে যে, গণমাধ্যম নামক সমাজের আয়নায় মানুষ আইনের আলোকেই নির্যাতিতর কথা প্রচার বা প্রকাশের বিষয়টি প্রত্যাশা করে। কারণ, কোন এক নির্যাতিত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশের সাথে জড়িয়ে থাকে ওই নির্যাতিতর পরিবার কিংবা তার স্বজনের ভবিষ্যৎ ও সামজিক বাস্তবতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)