কৃষি-অন্তঃপ্রাণ এক অর্থনীতিবিদের বিদায়

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশের হাতে গোনা যে কয়জন মানুষের সুগভীর পর্যবেক্ষণ, তার মধ্যে ড. মাহবুব হোসেন ছিলেন অন্যতম একজন। একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ হলেও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মূলধারা যে কৃষি, তা তার নিজস্ব চিন্তার জায়গাতে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল।

তাই যতটা না অর্থনীতিবিদ হিসেবে, তারচেয়ে বেশি কৃষি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে অল্প দিনেই তার গ্রহণযোগ্যতা ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নে তার পর্যবেক্ষণ আমাদের দেশে যেমন, একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিলো দারুণ গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত। তার আকস্মিক চলে যাওয়া আমাদের দেশের মূল স্রোতের উন্নয়ন চিন্তাজগতে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।

ড. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে আমার জানাশোনা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান করি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক। তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ওই প্রতিষ্ঠানেই। মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি দারুণ দক্ষতার পরিচয় রেখে চলছিলেন। অনেকটা নিভৃতচারী গোছের সাদাসিধে মানুষ ছিলেন তিনি। তখন থেকেই ড. মাহবুবকে আমি মাহবুব ভাই হিসেবে সম্বোধন করে আসছিলাম। তখন খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও সম্পর্কটি বেশ গভীর হয়ে ওঠে ২০০৪ সালে।

ড. মাহবুব তখন ফিলিপাইনের লাজব্যানোসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই বা ইরি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। আমি গিয়েছিলাম বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও ধান গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে কাজ করতে। তখন তাকে অনেকটা নিবিড়ভাবে পেয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম ধান গবেষণার ওই সময়ের অবস্থা সম্পর্কে। বলা বাহুল্য, ইরির ভূমিকা, উন্নয়নশীল বিশ্বের ধান গবেষণা, আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান এই বিষয়গুলো মাহবুব ভাই আমার সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। আমি একজন অর্থনীতিবিদের বিজ্ঞানচেতনা এবং মানবিক ও সমাজ দর্শন খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই।

আমার মনে আছে, মাহবুব ভাই বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা থেকে যে পরিমাণ তহবিল পেত, তা তখন অনেকটাই কমে এসেছে। তখন তিনি আজকের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশকে ধান গবেষণায় স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই। তহবিলের প্রশ্নে বাইরের পানে তাকিয়ে থাকার দিন মনে হয় শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি সে সময়ই বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন কৃষির গতি-প্রকৃতি পাল্টে যাওয়ার ইস্যুতে। জলবায়ুর পরিবর্তন, সমাজ ও রাজনৈতিক নানা বিষয়, আমাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিষয়গুলো তিনি বারবার চিন্তায় আনতেন।তিনি ছিলেন দারুণ উদার, সচেতন ও নিরপেক্ষ চেতনার মানুষ। তিনি সব সময় উন্নয়ন চেতনার পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। সরকারযন্ত্রের ইতিবাচক কাজকে বেশ আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতেন। কোনো কিছুকে উড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা তার ছিল না। তার সুগভীর বিশ্লেষণ ও মন্তব্যগুলো আমি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছি, তা কৃষির মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে শতভাগ সংগতিপূর্ণ। শুধু কাগজপত্রে হিসাবনিকাশ করে তার কাজ কখনোই শেষ করেননি তিনি, চেষ্টা করেছেন মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাকে সব সময় তার লেখনি, গবেষণা ও চিন্তার মধ্যে রাখতে। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ হিসেবে যে কাজটি অনেক বড়।

আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ ১৬ বছর দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাদেশে যখন চলে এলেন, তখন মাহবুব ভাই তার অবস্থানে থেকেই আমার কাজকর্মের বেশ সহায়ক হয়ে উঠলেন। আমি কয়েক দিন পরপরই তাকে চ্যানেল আই স্টুডিওতে পেয়েছি। কৃষির যেকোনো ইস্যু নিয়ে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। আমি যে অনুষ্ঠানগুলোতে নীতি পরিকল্পনা ও গবেষণাকে বিষয়বস্তু করেছি, সেখানেই ড. মাহবুবকে সর্বাগ্রে স্মরণ করেছি। অনেক অজানা বিষয় জেনেছি। কিছু বিষয় নিজের ভেতর খোলাসা করারও সুযোগ পেয়েছি।

আমি দেখেছি, মাহবুব ভাই কখনো শুধুই সমালোচনার জন্য সমালোচনা করতেন না। মিতভাষীও ছিলেন বৈকি। সব সময় কথা বলতেন হিসাব করে, চিন্তা করে, যাতে কথাটি কোনো না–কোনোভাবে উপকারে লাগে। কখনো তার আচরণে কাউকে আঘাত করার প্রবণতা ছিল না, বিরোধিতা করতেন তাও অত্যন্ত নমনীয়তার সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘ প্রজ্ঞা, চিন্তা ও বিনয়ী স্বভাবই বারবার উঠে এসেছে।

প্রান্তজনের অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন দেশের বর্গাচাষীদের ঋণপ্রাপ্তির বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল আমার। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ড. মাহবুবের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাককে কাজে লাগায় বর্গাচাষিদের মাঝে ঋণ বিতরণে। ঢাকায় আর্মি স্টেডিয়ামে বর্গাচাষিদের এক সম্মেলন হয়েছিল। বাংলাদেশে কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সেটি ছিল একটি মাইলফলক উদ্যোগ। সে অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ওই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পেছনে মাহবুব হোসেনের ছিল অনেক বড় ভূমিকা।

২০১৪ সালে পূর্ব আফ্রিকার রুয়ান্ডায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বায়োফর্টিফিকেশন সম্মেলন। আমার সুযোগ হয়েছিল ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকার। ওই সম্মেলনের একটি সেশনে সভাপতিত্ব করেন মাহবুব হোসেন। তিনি সুদীর্ঘ গবেষণার আলোকেই তার কাজের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন বিশ্বব্যাপী। যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ভূমি সংস্কার, দরিদ্র কৃষক, কৃষি ও কৃষকের ঝুঁকি, ধান গবেষণার প্রভাব ও বাস্তবতা, সবুজ বিপ্লব, এশিয়ার কৃষিনির্ভর দেশগুলো ছিল তার গবেষণার বিষয়।

২০১৪ সালের বইমেলায়ও মাহবুব ভাইকে কাছে পেয়েছিলাম আমার একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে। অনেক গল্প-গুজব ও ভাব বিনিময় হয়েছিল বইমেলা প্রাঙ্গণের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে। যা হোক, এমন টুকরো টুকরো বহু স্মৃতি আছে মাহবুব হোসেনের সঙ্গে। তিনি তার অবস্থানে কৃষি অর্থনীতির বিষয়গুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ছিলেন অকপট। নিজস্ব প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজস্ব তাগিদ বা গভীর দায়িত্ববোধ থেকেই।

কৃষি তার মূল বিষয় ছিল না। কিন্তু তিনি কৃষিকে তার অধ্যয়নের বিষয়ের চেয়েও এনেছিলেন সামনে। আমিও কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করিনি। পড়েছি ভূগোলে, কিন্তু তীব্র অনুরাগ নিয়ে লেগে আছি কৃষিতে। হয়তো সে কারণেই এ দেশের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোর সঙ্গে চেনা-জানার সুযোগ হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জায়গা থেকে যে কথা আজ গভীরভাবে মনে হচ্ছে তা হলো, কৃষির ন্যায্যতার প্রশ্নে দায়িত্ব নিয়ে কথা বলার মতো মানুষের বড্ড অভাব আমাদের দেশে। যে একজন ছিলেন, তিনিও চলে গেলেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ড. মাহবুব হোসেনশাইখ সিরাজ