কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠতম নফল ইবাদত

আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ কুরআন মাজীদ। এ গ্রন্থ নিছক অর্থগত কোনো গ্রন্থ নয়। এটি শব্দ এবং অর্থে সমৃদ্ধ মেলবন্ধন মাত্র। অর্থ উপলব্ধির পাশাপাশি এর শব্দপঠনেও রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। কুরআনের পঠন শুনে কত অমুসলিম যে মুসলিম হয়েছে, কত পাথর যে জলে গলে গেছে– তা অগণ্য। 
কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না’ (আল-কোরআন)। এজন্য ইসলাম কুরআন সংরক্ষণ ও কুরআনের প্রয়োজনীয় অংশ মুখস্থকরণে তাগিদ প্রদান করেছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই যার অন্তরে কুরআনের কিছু অংশ নেই, সে যেন এক উজার ঘর’ (তিরমিজী)।
কুরআন পাঠ একটি স্বতন্ত্র ইবাদতও বটে। নফল ইবাদতে এটির অবস্থান সর্বশীর্ষে। কুরআন তিলাওয়াতকে সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ কিয়ামতের দিন কুরআন পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে’ (সহিহ মুসলিম)।
এই নফল ইবাদতটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এর পঠনে রয়েছে অগুনতি সওয়াব। সেই নেকীর হিসাব প্রকাশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ বা অক্ষর পাঠ করবে, তার জন্য একটি নেকী। প্রত্যেকটি নেকীই দশটির সমান। আমি তোমাদের বলছি না যে, ‘আলিফ লাম মিম’– একটি হরফ মাত্র। বরং আমি বলছি: আলিফ একটি হরফ। লাম একটি হরফ, মিম একটি হরফ’ (তিরমিজী)।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন: ‘তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দু’টি আয়াত পাঠ করে বা শিখে, তাকে দু’টি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। এভাবে যত বেশি আয়াত তিলাওয়াত করবে, ততবেশি উট সদকা করার সওয়াব প্রদান করা হবে’ (সহিহ মুসলিম)।
কুরআন তাঁর পাঠকারীর জীবনকে বরকতময় করে তুলে। শুধু পার্থিব জীবনই যে বরকতমণ্ডিত হয়, তা নয়। ভরপুর নূরে নূরান্বিত হয়ে উঠে তিলাওয়াতকারীর পরকালীন জীবনও।
হাদিস শরীফে এসেছে– ‘হযরত আবু যর গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত। একদা আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি ইরশাদ করলেন: তুমি বেশিবেশি আল্লাহকে ভয় করবে। কেননা তা হচ্ছে সকল বিষয়ের মূল। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আরো উপদেশ দিন। তিনি ইরশাদ করলেন: তুমি কুরআন তিলাওয়াত করবে। কেননা, তা তোমার জন্য এই জমীনে নূর এবং আসমানে সঞ্চিত সম্পদ’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)।
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে– ‘যে ব্যক্তি কুরআন অনুসরণ করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়াতে পথভ্রষ্ট না হওয়া এবং আখেরাতে হতভাগা না হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন’ (মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বাহ)।
একজন ব্যক্তি যখন কুরআন তিলাওয়াতে নিজেকে নিমগ্ন রাখে, সে ধীরে ধীরে আল্লাহ তায়ালার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এই হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য– তিনি বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই মানবশ্রেণীতে আল্লাহর কতিপয় সঙ্গী রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা কারা? তিনি বললেন: তারা হচ্ছে কুরআনের সঙ্গী। তারাই আল্লাহর সঙ্গী ও বিশেষ মেহমান’ (নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)।
এভাবে একজন তিলাওয়াতকারী পৌঁছে যান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তদের কাতারে। অন্তর্ভুক্ত হন সেসকল বান্দাদের তালিকায়, যারা আল্লাহর ভাষায় ‘অনুগত’ হিসেবে পরিচিত। হাদিস শরীফে আছে– ‘যে ব্যক্তি প্রতি রাতে দশটি করে আয়াত পাঠ করবে, আল্লাহর দরবারে সে গাফেল তথা অমনোযোগী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (হাকেম)। আরো ইরশাদ হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সংরক্ষণ করবে, তার নাম কখনোই গাফেলদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হবে না। আর যে ব্যক্তি প্রতি রাতে একশোটি করে আয়াত পাঠ করবে, তার নাম আল্লাহর অনুগত বান্দাদের মধ্যে লিপিবদ্ধ হবে’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা)।
এজন্য তারা অন্যান্য বান্দাদের নিকট ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেন। তাঁদের সম্মান এত বেড়ে যায় যে, কুরআন তিলাওয়াতকারীকে দেখে ঈর্ষা করাও শরীয়তে অনুমোদিত। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘দুটো ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যকোথাও ঈর্ষা করা যায় না। এক, ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআন দিয়েছেন। অতঃপর সে তা নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে। দুই, ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পদ দিয়েছেন। অতঃপর সে তা সকাল-সন্ধ্যা দান করে যায়’ (বুখারী ও মুসলিম)।
যারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতে সময় ব্যয় করবে, কুরআন তাদের হতাশ করবে না। হাশরের ময়দানে যখন বাবা আপন সন্তানকে চিনবে না, সন্তান মা-বাবাকে চিনবে না, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ভুলে যাবে পারস্পরিক মায়াবী সম্পর্কের বন্ধন। ঠিক তখনই কুরআন স্বীয় তিলাওয়াতকারীকে চিনে নেবে। শাফায়াত করবে তার জন্য। এজন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন: ‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো। কেননা, তা কিয়ামত দিবসে পাঠকারীর জন্য সুপারিশকারী হয়ে আগমন করবে’ (মুসলিম)।
বর্তমানে আমরা পবিত্র মাস রমজান পার করছি। এ মাসের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দিক হলো– এতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই কুরআনের সাথে রোজার রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। মহাপ্রলয় দিবসে এ দুটো একসাথে আগমন করবে শাফায়াত করতে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করবেন’ (বায়হাকি শরীফ)।
যেহেতু কুরআনের সাথে জুড়ে থাকলে শাফায়াতের নিশ্চয়তা রয়েছে, সেহেতু রমজান মাসে অধিকহারে কুরআন তিলাওয়াতের বিকল্প নেই। তবুও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে– মুসলমানরা দিনদিন কুরআন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কুরআন শিক্ষা হয়ে পড়ছে অবহেলিত এবং কম জরুরি কার্যাদির অন্তর্ভুক্ত। অথচ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যিনি কুরআন মজিদ শিক্ষা করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়’ (সহিহ বুখারী)।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনকে চিহ্নিত করেছেন সর্বোত্তম হওয়ার মাপকাঠি হিসেবে। আজ এ জাতি অধম হয়ে পড়ছে। অধঃপতন, অবনতির অতল গহ্বরে ডুবে মরছে৷ প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে তুলনামূলক অধম জাতিগুলোর হাতে।  কারণ কী? তা খুব সুন্দরভাবে কাব্যিক ভাষায় দুই লাইনে ব্যক্ত করেছেন মহাকবি আল্লামা ইকবাল (রহ.)– ওয়হ জমানে মে মুয়াজ্জজ থে মুসলমান হো কর, অউর তুম খার হোয়ে তারেকে কুরআন হো কর। অর্থাৎ ‘ছিলে নন্দিত মুসলমান সেকালে, হলে নিন্দিত কুরআন ছেড়ে একালে।’
কুরআন তিলাওয়াতরমজান