কাক, কাকের মাংস ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ৫৭ ধারায় মামলা

আমরা জানি যে, কাক কখনও কাকের মাংস খায় না। তার মানে কাক একই সম্প্রদায়ের কারও ক্ষতি করে না। বরং কেউ বিপদে পড়লে কা-কা চিৎকার করে অন্যদেরও জানান দেয়। তারপর সবাই মিলে চেষ্টা করে কীভাবে বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করা যায়। কাক-সমাজে যে সহমর্মিতা, ‘ফেলো-ফিলিংস’ আছে, আমাদের মানুষের মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে তা নেই! এরপরও আমরা মানুষ হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে গর্ব করি কীভাবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি সামান্য ঘটনা। রেজাল্ট দেয়া নিয়ে বিলম্ব ঘটেছিল। বিলম্বের কারণ একজন শিক্ষকের রেজাল্টশিটে নাকি ‘কাটাকুটি’ ছিল। এই রেজাল্ট প্রস্তুত-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল মনসুর আহমেদ। তাঁর ভাষ্য মতে, ‘‘রেজাল্ট প্রস্তুত করতে গিয়ে দেখলাম ড. গীতি আরা নাসরীনের নম্বরপত্রে অনেক কাটাকাটি। ২৪ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আমি কোনও দিন এমন দেখিনি। ড. এ এস এম আসাদ  (সেও টেবিলেটর ছিলেন) আর আমি দু’জন টেবুলেটর একমত হলাম, কন্ট্রোলারের কাছে গেলাম এবং লিখিতভাবে জানালাম, কী করব? কন্ট্রোলার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানালেন এবং বিষয়টি শৃঙ্খলা কমিটিতে চলে গেল। শৃঙ্খলা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের কন্ট্রোলারের দফতরের মাধ্যমে অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, পরীক্ষায় গীতি আরা নাসরীন প্রদত্ত মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাদ দিয়ে বাকিদের নম্বর গড় করে প্রস্তুত করার জন্য। সেই মোতাবেক ২০ জুন আমরা রেজাল্ট জমা দিলাম, প্রকাশিত হলো।’’

উল্লিখিত ভাষ্যটুকু পড়ে যে কারোরই মনে হতে পারে, সব ঠিকঠাক মতোই তো চলছিল, তাহলে মামলা হলো কেন? আসলে ড. আবুল মনসুর আহমেদের ভাষ্য মতো সব কিছু ঘটেনি। বিষয়টি নিয়ে একাধিক পক্ষ সৃষ্টি হয়। তাদের পক্ষ থেকে নানা ভাবে জল ঘোলা করা হচ্ছিল। একটি মহল ইচ্ছেকৃতভাবেই ড. গীতি আরা নাসরীনের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছিলেন। ৬ষ্ঠ ব্যাচের এমএসএস শিক্ষার্থীদের একটা গ্রুপ আছে ফেসবুকে, সেখানে বিভাগের অপর এক শিক্ষক ড. ফাহমিদুল হক একটা পোস্ট দেন। তিনি গীতি আরার পক্ষে যুক্তি-ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। এতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। ড. আবুল মনসুরের ‘মান-ইজ্জতে’ টান পড়ে। তিনি ‘মান’ বাঁচাতে ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেন! যদিও এ ব্যাপারে ফাহমিদুল হক বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্বের জায়গা থেকেই আমি পোস্টটি দিয়েছি। মানহানির কোনও উদ্দেশ্য আমার দিক থেকে ছিল না।’

ড. ফাহমিদুল হক (বামে), ড. আবুল মনসুর আহমদ (ডানে)

একই বিভাগের দুজন শিক্ষক। প্রতিদিনই তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আলাপ-আলোচনা করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফোরাম আছে, বিভিন্ন ধাপ আছে, কমিটি আছে, তাদের কাছে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ ছিল। কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন সহকর্মীর বিরুদ্ধে, একই বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে! ফাহমিদুল হক যে মন্তব্য করেছেন, তা ছিল একই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি ছোট বা ক্লোজড গ্রুপে। যার সদস্য মাত্র ৬৯ জন সদস্য ছিল ( গ্রুপটির এডমিন ছিলেন মাস্টার্সের একজন শিক্ষার্থী। পরে গ্রুপটি ডিলিট করে দেয়া হয়)। বিষয়টি যদি উন্মুক্ত বা পাবলিক গ্রুপে হতো, যেখানে হাজার হাজার জনের দেখার, মত দেয়ার সুযোগ থাকতো, তাহলেও না হয় একটা কথা ছিল। ক্লোজড গ্রুপের একটি আলোচনা, তাতেই ওই শিক্ষকের ‘মানহানি’ হলো কিভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মান কি এতই ঠুনকো? একজন সাধারণ সাধারণ পাঠক হিসেবে গণমাধ্যমে ঘটনাটি পাঠ করে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি যেন সেই গ্রামের মামলাবাজ কুটিল ব্যক্তির কাহিনী পড়ছি, যে কিনা প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে সারাক্ষণ আদালত চত্বরে কাটান! বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক এমন কাণ্ড করতে পারেন, তা সত্যিই দুঃখজনক!

আমরা দেখেছি, সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে সারাদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একাট্টা হয়েছেন। এই আইনের পক্ষে যুক্তি দিতে না পেরে সরকারও এই ধারাটি বাতিলের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে মাত্র পাঁচদিন আগেও ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এর তিন দিনের মাথায় এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। এতে করে ওই ব্যক্তির ‘মান’ নয়, বরং বোধ-বুদ্ধি নিয়েই প্রশ্ন তোলার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।

কারণ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মূলত গণমাধ্যম ও গণযোগাযোগ নিয়ে পড়ানো হয়। এই বিভাগে অনেক নিয়ম-নীতি ও আইন পড়ানো হয়। মানুষের বাকস্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ৫৭ ধারা বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় একটা প্রতিবন্ধক। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, সংবিধান আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা দিয়েছে। আর ৫৭ ধারা তা হরণ করেছে। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষই চাইছেন, এই ধারাটি বাতিল করা হোক। এমন পরিস্থিতিতে ৫৭ ধারায় মামলা করে বিভাগের একজন শিক্ষকের বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘মামলাবাজ’ ওই  শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কি পড়াবেন, কোন নৈতিকতা শেখাবেন?

ড. ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ

মনে রাখা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তিনি অবশ্যই মান্যজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এ জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। জ্ঞানে-গুণে, মেধায়-যোগ্যতায়, মানবিক উৎকর্ষে, বুদ্ধি-বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ হতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। আগে অন্তত তা-ই দেখা যেত। তাই আমরা তাদের মান্য করি, সম্মান দেই, সমীহ করি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি।

আমরা বিশ্বাস করি, সমাজের অগ্রসর ও শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন। হিংসায় উন্মত্ত, ক্ষমতার নেশায় বিভোর, স্বার্থোদ্ধারের চেষ্টায় যখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষ ব্যাকুল, তখন ক্ষুদ্রতামুক্ত লোভ-মোহ-সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রুখে দাঁড়াবেন। দেশের অন্যত্র যাই ঘটুক, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে কোনো অন্যায়, পক্ষপাত, নীতিগর্হিত কাজ তারা হতে দেবেন না। এ জন্য প্রয়োজনে তারা বুকের রক্ত দেবেন। প্রাণ উৎসর্গ করবেন। যুগে যুগে আমাদের সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাই করেছেন। ন্যায়ের জন্য, অধিকারের জন্য, শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কখনও তারা কুণ্ঠিত হননি।

কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। সমাজের সার্বিক অধঃপতন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও গ্রাস করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এখন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই লোভী, ধান্দাবাজ ও হিংস্র হয়ে উঠছেন। স্বার্থোদ্ধার, সুবিধা আদায় আর ধান্দাবাজিতে তারা অনেকে এখন অধম হয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে নির্লোভ-নির্মোহ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার জ্ঞানতাপস– এই ধারণা এখন আমূল বদলে গেছে। আর দশজন সুবিধাবাদী নষ্ট মানুষের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পার্থক্য করা কঠিনতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে!

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকরা যেন দলবদ্ধভাবে নীতি-নৈতিকতা-বিবেক ইত্যাদি বিসর্জন দিয়েছেন। দলের মাদল না বাজলে তাদেরও যেন এখন আর ভালো লাগে না। দলের চশমা ছাড়া তারা কিছুই দেখতে পান না, দেখতে চানও না।

এর বাইরে যারা দলবাজির গড্ডল প্রবাহে গা না ভাসিয়ে একটু নিজেদের স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে পথ চলেন ও যুক্তি-বুদ্ধির চর্চা করেন, তাদের প্রতি পদে জব্দ করার, উচিত শিক্ষা দেওয়ার একটা সংকীর্ণ মনোভাব প্রবল ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই সর্বনাশা প্রবণতা থেকে যদি আমরা সরে না আসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মুক্ত না হন, তাহলে সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে কীভাবে?

মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। না থাকলে আমরা দেবতা হয়ে যেতাম। সেগুলো যৌক্তিকভাবে তুলে না ধরি, নিয়মতান্ত্রিক কায়দায় সমস্যা সমাধানে প্রয়াসী না হই, নিজের পক্ষে না গেলেই বুনো ষাঁড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি, তাহলে আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করব কোন মুখে? নিজে শিক্ষক হয়ে অপর শিক্ষকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে ঝাল মেটানোর উদ্যোগ কি কখনও সমর্থনযোগ্য হতে পারে? না তাই হওয়া উচিত?

যে কোনো সমাজের অবক্ষয় হলে তা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে স্পর্শ করে। মানুষ প্রাকৃতিকভাবে যে বুদ্ধি-বিবেক পেয়েছে তা অন্য কোনো প্রাণী পায়নি। তাই জন্মগতভাবে একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে যা সহজাত, তা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কাক কাকের মাংস খায় না- এটি কাকের জন্মগত ও সহজাত বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে যতদিন কাকের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন খুব সম্ভবত এ বৈশিষ্ট্যের অন্যথা হবে না। কিন্তু আমাদের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যারা স্বজাতির প্রতি, সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল বা সহমর্মী নন, চান্স পেলেই জব্দ করতে চান, দেখিয়ে দিতে চান, উচিত শিক্ষা দিতে চান, পারলে হাড়-মাংস চিবিয়ে খেয়ে গুষ্টি উদ্ধারে নেমে পড়েন, তাদের আমরা কি বলব? তারা কি কাকের চেয়ে উত্তম, না অধম?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

৫৭ ধারা৫৭ ধারায় মামলাউচ্চশিক্ষাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়