কাউকে টার্গেট করে সাংবা‌দিকতা নয়

‌শৈশব কৈশোর থেকে আমি প‌ত্রিকা প‌ড়ি। রী‌তিমত সম্পাদকীয়সহ। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম। টানা ১৫ বছর সাংবাদিকতা করেছি। এর মধ্যে ১২ বছরই ছিলাম প্রথম আলোতে। অহঙ্কার নয়, খুব ভালো লাগা নিয়ে বলতে পারি এই ১৫ বছরে আমি কখনো ব্যক্তিস্বার্থে সাংবাদিকতা করিনি।

‌কোনটা নিউজ আর কোনটা নয় আমি খুব সহজভাবে ভাবতাম। আমি হিসেব করতাম এই নিউজটা করলে দেশ, জাতি, সাধারণ মানুষ নিদেনপক্ষে কোন একজন মানুষের মঙ্গল হবে কী? যদি উত্তর হ্যাঁ হতো তবেই আমি নিউজটা করতাম। কখনো কোনদিনও ব্যক্তিগত হিংসা বিদ্বেষ থেকে কারো বিরুদ্ধে নিউজ করিনি। আর সে কারণেই যখন যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি সেই প্রতিষ্ঠানকে অনেক সময় অনেক লোকজন গালি দিলেও আমাকে গালি দেয়নি।

একযুগ থাকার কারণে প্রথম আলোকে নিয়ে গালিগালাজ নিয়মিতই শুনতে হয়েছে। এই গা‌লিগালাজকারীদের একটা বড় অংশই ছিলো সরকারি দলের লোকজন যারা অকারণেই গালি দিতো। কিন্তু খুব ভালো লাগা নিয়ে বলতে পারি ব্যক্তি শরিফুল হাসানকে বা তাঁর কাজের জন্য কখনো গালি খেতে হয়নি। ফেসবুকে প্রথম আলোর নানা নিউজের নিচে প্রচুর গালিগালাজ থাকলেও আমার নিউজের ক্ষেত্রে এমনটা হতো না বললেই চলে।

কথাগুলো বলার কারণ আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনে কখনো টার্গেট করে কারো বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা করিনি। কতোজন কতো কথা বলেছে, কতো কাগজপত্র দিয়ে গেছে কতোজনের বিরুদ্ধে কিন্তু যাচাই বাছাই না করে, প্রমান না নিয়ে কারো বিরুদ্ধে নিউজ লিখিনি। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে নিউজ গেছে তারাও পরে স্বীকার করেছে আমি তথ্য প্রমাণ নিয়ে ঠিক লিখেছি।

২০১১ সালে নারায়নগঞ্জ সি‌টি কর্পোরেশন নির্বাচনে টানা একমাস আমি সেখানে থেকে নিউজ করেছিলাম যার অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু তারপরেও শামীম ওসমান আমার সাথে প্র‌তি‌দিন কথা বলতেন, আজও বলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলতেন আমি কখনো তাকে মিসকোট করিনি। কখনো বানিয়ে কিছু লিখিনি।

টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সাংসদ কাদের সিদ্দিকী কিংবা খুলনার আরেক প্রভাবশালী সাংসদের বিরুদ্ধেও নিউজ করেছিলাম। প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রায়ই আমার নিউজ যেতো। তিনি আমাকে কখনো ফোনে, কখনো সরাসরি ডেকে ব্যাখ্যা চাইতেন। হুমকি দিতেন। আমি খুব বিনয়ের সাথে মাথা উঁচু করে আমার তথ্য প্রমান যুক্তি দিতাম। তিনি আর কিছু বলতেন না।

যে প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলাম সেটি হলো আমি আমার ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে বারবার দেখেছি বিরাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছে যার থেকে আমি মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। কোন কর্মকর্তা বা কেউ খারাপ ব্যবহার করলে অনেক সাংবা‌দিক‌কে বলতে শুনেছি আপনাকে দেখে নেব। এক্ষেত্রে ছোট ছোট পত্রিকা বা অনলাইগুলোর সাংবাদিকরা বেশি এগিয়ে।

প্রা‌তিষ্ঠা‌নিকভাবে সেটা ব্যাপকভাবে দেখলাম কালের কন্ঠ পত্রিকা আসার পর। তারা কোন কারণ ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে লতিফুর রহমান আর প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নিউজ করে গেলো। অথচ আমার সাংবাদিকতার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলছি বাংলাদেশে লতিফুর রহমানের মতো যদি আর পাঁচজন মালিক থাকতেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের চেহারা পাল্টে যেতো। এমন ভালো মালিক এদেশের গণমাধ্যমে নেই বললেই চলে। আজকে প্রথম আলো ডেইলি স্টারের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ম্যাজিক এই লতিফুর রহমান যিনি কখনোই তার মালিকানাধীন কোন পত্রিকায় হস্তক্ষেপ করেন না। নিজের কোন চাওয়া পাওয়া পত্রিকার উপরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন না। কখনো বলেন না ওমুকের বিরুদ্ধে বা ওমুকের পক্ষে নিউজ করতে হবে।

অথচ এদেশের শীর্ষস্থানীয় বাকি পত্রিকাগুলোর মালিক বা সম্পাদকদের অনেকেই ব্যস্ত নিজেদের ধান্দায়। তারা এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে নিউজ করায় নানা স্বার্থে। এসব পত্রিকার অনেক সাংবাদিকের কাজই হ‌লো মালিকের এসব স্বার্থ রক্ষা করা। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু সাংবাদিক গড়ে ওঠে যারা মালিক সম্পাদকদের ফরমায়েশি এসব সংবাদ তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজ কাউকে টার্গেট করে নিউজ করা। সেটা কখনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।

অথচ সাংবাদিক বা সাংবা‌দিকতার ছাত্র হিসেবে আমি বিশ্বাস করেছি, চর্চা করেছি যে নিউজ হতে হবে নিউজের মেরিটে। জোর করে কারো বিরুদ্ধে বা কারো পক্ষে নিউজ করা কখনোই উচিত নয়। কিন্তু আজকাল দেখছি ব্যক্তি টার্গেট করে নিউজের সংখ্যা বাড়ছে। কখনো সেটা কারো পক্ষে, আবার কারো বিপক্ষে। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বড় টার্গেট হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন স্যার।

আমি বলছি না আরেফিন স্যার ফেরেশতা। তিনি মানুষ কাজেই তার অনেক দোষ থাকবে। আর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে দলীয় নিয়োগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কোন ফেরেশতাকে বসালেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তি‌নি এটা না করেও পা‌রবেন না। হ্যা, এসব নিয়োগ নিয়ে নিউজ হতেই পারে। কিন্তু পাশাপাশি গত আট বছরে যে একদিনও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো না, সেশনজট এখন নেই সেগুলো কী নিউজ নয়?

আমাকে কেউ কী বলতে পারেন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি‌সি দলীয় নয়? আর এই যুগে অধিকাংশ উপাচার্য যখন নিজেরা অসৎ, আর্থিক লুটপাটে ব্যস্ত তখন যে আরেফিন স্যার একজন সৎ মানুষ সেটা কী নিউজ নয়? বিশেষ করে এই নষ্ট সময়ে যেখানে উপাচার্যরা নিজেদের বেতন ভাতা তো নেনই উল্টো বৈশাখি ভাতা উৎসব ভাতাসহ নানাভাবে অর্থ লোপাট করেন সেখানে উপাচার্য আরেফিন শুধু সৎ নন নিজের প্রাপ্য কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেন সেটা কী নিউজ নয়? আমি খুব কষ্ট নিয়ে দেখেছি এই নিউজটা কেউ কেউ সযত্নে এড়িয়েছে। কারণ আরেফিন স্যারের ভালো কিছু যে বলা যাবে না। তারা বরং পুরোনো নিউজগুলো আবার নতুন করে হাজির করছে আরেফিন স্যারকে খারাপ প্রমাণ করতে। একইদিনে একাধিক গণমাধ্যমে এই ধরনের নিউজ দেখছি। সবার স‌ম্মি‌লিত উদ্দেশ্য বোধহয় একটাই উপাচার্য আরেফিনকে ‌ঠেকানো। সবাইকে বোঝানো তিনি খারাপ। আর এখানেই আমার আপত্তি।

ওহে সাংবাদিক ভাইয়েরা কেউ খারাপ করলে অবশ্যই নিউজ করবেন কিন্তু ‌তি‌নি যখন ভালো করেন তখন কেন সেটা সযত্নে এড়াবেন? আজকে আপনারা আরেফিন স্যারের বিরুদ্ধে লিখলেন সে‌দিন কেন তার কো‌টি টাকা না নেওয়ার নিউজটা করলেন না? তার মানে কী এই আপনারা কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে শুধুই তার নিউজ করছেন। এটা তো কখ‌নোই সাংবাদিকতার নীতির সঙ্গে যায় না।

শুরুতে বলেছি, আমি শরিফুল হাসান আমার ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে কখনো কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে টার্গেট করে নেমে নিউজ করিনি। আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কাছেও আমার অনুরোধ কখনো নিজের বা মা‌লিক সম্পাদকের স্বার্থ উদ্ধারে কারো প্রতি অনুরাগ বিরাগ থেকে সাংবাদিকতা করবেন না। আমরা সাংবাদিকরা যদি ব্যক্তিগত রাগ অনুরাগের বাইরে বের না হতে পারি তবে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিবিদ কারো সমালোচনা করা আমাদের শোভা পায় না।

শুধু সাংবাদিক নয় বিচারক পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ জনপ্রতিনিধি সবার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। এই পেশার মানুষগুলো রাগ অনুরাগ বিরাগ বা কারো স্বার্থে কাজে লাগলে দেশ ধ্বংস হবেই।

শেষ করছি হযরত আলী (রাঃ) এর ঘটনা দিয়ে। কোন এক যুদ্ধে কোন এক কাফরেকে হত্যার জন্য তিনি তলোয়ার বের করেছেন। এমন সময় ওই কাফের হযরত আলীর মুখে থুথু দিলেন। হযরত আলী তখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। তবে তিনি তার ত‌লোয়ার না চা‌লি‌য়ে থে‌মে গে‌লেন। বাকি সাহাবিরা কারণ জানতে চাইলে হযরত আলী বললেন আমি তাকে হত্যা করলে সেটা ইসলাম বা যুদ্ধের জন্য হতো না। সেটা হতো ব্যক্তি আলীর ক্ষোভ রাগ। আমি সেখান থেকে নিজেকে সংযত করেছি। কারণ আমি আমার স্বার্থেই ইসলামের নামে কাউকে হত্যা করতে পা‌রি না।

যে কথাগুলো বললাম একান্তই আমার মত। আমার মনে হয় সাংবাদিক পুলিশ বিচারক শিক্ষক ডাক্তারসহ আমরা যে যে পেশায় আছি আমরা যেন ব্যক্তিগত রাগ অনুরাগ থেকে দূরে থেকে কাজ ক‌রি। তবেই আসবে পেশাদারিত্ব। এগিয়ে যাবে রাষ্ট্র সমাজ, দেশ। নয়তো, সব‌কিছুই এক‌দিন নষ্ট‌দের দখলে যাবে। তার দায় আপনি আমি কেউ এড়াতে পারবো না।

-লেখক বর্তমানে একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। নিয়‌মিত লেখালেখি করেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়