মাহবুবুল হক শাকিল আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত শতকের আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচার ও মৌলবাদ বিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ শহরে বেড়ে ওঠা শাকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার সুন্দর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। আয়তনে ও আকারে অত্যন্ত ছোট একটি আবাসিক ছাত্রাবাস স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্র হলেও সবগুলো হলে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। প্রতিটি হলের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ছাত্র-আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
কবে, কখন ও কিভাবে শাকিলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয় তা ঠিক মনে নেই। মিছিল-মিটিং-আন্দোলনে যে কোন প্রয়োজনে হাত বাড়ালেই শাকিলকে পাওয়া যেতো। আমাদের ছাত্ররাজনীতির প্রাক্কালে কম্পিউটার ছিল না। ফলে হাতের লেখা দিয়েই বিবৃতি দেয়া হতো। যে কোন ঘটনার বিবৃতি দেয়া এবং তা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। যদিও এটি দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব। তথাপি সে সময়কালে আমাদের প্রচার, প্রকাশনা ও বিবৃতিকে ঘিরে একটি টিম গড়ে উঠেছিল। সে টিমের সদস্যরা ছিলেন জনাব আহমদ হোসেন (বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), মোশাররফ হোসেন (আমার কমিটির দপ্তর সম্পাদক), নুরুল আমিন রুহুল (আমার কমিটির প্রচার সম্পাদক), কামরুজ্জামান আনসারী এবং মাহবুবুল হক শাকিল। এই টিমের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিল শাকিল। ফলে, অন্যদের ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকলেও শাকিলের ফাঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না। আমরাও শাকিলের উপর তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভর করতাম। শাকিলও নির্দ্বিধায় আমাদের দেয়া যে কোন নির্দেশ পালনে ছিল আন্তরিক। আমরা বলে দিতাম আজকের এই ঘটনার উপর একটি বিবৃতি দিতে হবে। আর কোন ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতো না। সে বিবৃতি লিখে নিজহাতে পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিয়ে হলে ফিরতো। শাকিলের হাতে লেখা বিবৃতি আমাদের কোনোদিন সংশোধন করতে হয়নি। এক্ষেত্রে তার জ্ঞানের গভীরতা ছিল অপরিসীম।
ছাত্রলীগ, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের মিছিলে তার কণ্ঠস্বর ছিল সর্বদলের ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। কারণ, শাকিল খুব সুন্দর করে সুমধুর শ্লোগান দিতো এবং একনাগাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্লোগান দিতে পারতো। আশি ও নব্বইয়ের দশকের ছাত্ররাজনীতিতে মিছিল করে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করলেই চলতো না, মাঝে মাঝে ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কও প্রদক্ষিণ করতে হতো। অবশ্য, সেক্ষেত্রে আমি নিজেও দীর্ঘসময় এবং অনবরত শ্লোগান দিতে পারতাম। আমি শ্লোগান দিচ্ছি হঠাৎ করে আমার পিঠে কেউ একজন হাত দিচ্ছে, তাকিয়ে দেখি শাকিল। তখন বুঝতে পারতাম আমার রেস্ট দরকার, এবার শাকিল শ্লোগানে নেতৃত্ব দিবে। শাকিল মাঝে মাঝে শ্লোগান তৈরি করতো। কোন একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনার আলোকে আজকের মিছিল নতুন শ্লোগান দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে শাকিল বসে চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করে একটি শ্লোগান ঠিকই তৈরি করে নিতো।
১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতি থেকে আমি বিদায় নেই। সে সময়কালে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা ছাত্ররাজনীতির বয়সসীমা বেঁধে দেই ২৭ বছর। পূর্বে ছাত্ররাজনীতিতে এসবের কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে হঠাৎ করেই তুলনামূলক নতুন নেতৃত্বের কতগুলো নাম সামনে চলে আসে। তন্মধ্যে মাহবুবুল হক শাকিলের নাম উল্লেখযোগ্য।
নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নীতি-নির্ধারক মহলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীকে সভাপতি এবং মাহবুবুল হক শাকিলকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে পরবর্তী দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত হই। তখন রাত দশটা। সারাদেশের কাউন্সিলার ও ডেলিগেটরা উপস্থিত, তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নতুন নেতৃত্বের নাম জানার জন্য।
এদিক সেদিক নানা গুঞ্জরণ কিছু চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। উপস্থিত সাবেক এবং বর্তমান ছাত্রনেতাদের কাছে সেই মুহুর্তে কমিটি ঘোষণাটা সমীচীন মনে হয়নি। ফলে উপস্থিত সকলে মিলে একমত হই যে, রাতে নয় বরং আগামীকাল সকালবেলা নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। আমরা এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়ে চলে যাই নিজস্ব আস্তানায়।
সকালে যখন আমরা সমবেত হলাম বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ে নতুন কমিটি ঘোষণার জন্য, তখন দেখলাম অনেককিছু পাল্টে গেছে। নীতি-নির্ধারকরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, মাহবুবুল হক শাকিল নয়, সাধারণ সম্পাদক হবেন ইকবালুর রহিম। সভাপতি পদে মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর নাম অপরিবর্তিত থেকে যায়। সাবেক ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে শাহে আলম, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, এস এম কামাল হোসেন এবং আমি নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করলাম। ২৭ বছর বয়সী নতুন নেতৃত্ব নিয়মিত ছাত্রদের মধ্যে থেকে নতুন নেতৃত্ব। চট্টগ্রামের ছেলে মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী সভাপতি এবং দিনাজপুরের ছেলে ইকবালুর রহিম সাধারণ সম্পাদক। নতুন কমিটিতে মাহবুবুল হক শাকিল নির্বাচিত হলেন সাংগঠনিক সম্পাদক।
এসব ১৯৯২ সালের কথা। তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। আমরা যখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দায়িত্ব নিয়ে পুরোদস্তুর ব্যস্ত শাকিলও তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত। আওয়ামী লীগের সৃজনশীল প্রতিটি কাজে শাকিল ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রচার, দপ্তর, তথ্য ও গবেষণা সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল শাকিলের উজ্জল উপস্থিতি।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও শাকিল ছিল নির্লোভ নির্মোহ একজন মানুষ। তার আচার আচরণে কেউ কখনো কষ্ট পেয়েছে বলে শুনিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগও কেউ করেনি। এরকম সদালাপী, বন্ধুবৎসল, নিরহংকারী, সৎ, নির্লোভ এবং নির্মোহ মানুষের বড় বেশি প্রয়োজন আজকের রাজনীতিতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)