প্রত্যাশা ছিল নতুন একটা পৃথিবী পাবার। যেখানে মানুষ নিজেদের ভুলকে শুধরে নিয়ে ন্যায় ও সততার সাথে পথে চলবে। কিন্তু এ প্রত্যাশা কেবল স্বপ্ন হয়ে রইল। করোনাভাইরাস পারেনি মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দিতে। বরং করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালের শুরুতেই করোনাভাইরাস মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। সারা বিশ্বে বিগত ৮ মাসে প্রায় ২ কোটি ৩১ লক্ষ ৭ হাজার মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যু হয়েছে ৮ লক্ষ ৩ হাজার ৫৫১ জনের।
বছরের প্রায় ৪/৫ মাস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল মানুষ, দেশ তথা সমগ্র পৃথিবী। শুধু জীবন রক্ষার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ঘর বন্দি হয়েছে মানুষ। এতে করে বিশ্ব স্থবির হয়ে গেছে অর্থনৈতিকভাবে। যার প্রভাবে কম বেশি সকল মানুষ আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পায়নি বাংলাদেশও।
গত মার্চ মাস থেকে করোনাভাইরাসের আঘাতে বাংলাদেশের জনজীবনে এক আতংকময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে ঘরবন্দি জীবন কাটাতে হয় লকডাউনের সময়কালে। মানুষের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। সরকার জনগণের জন্য নানাভাবে ত্রাণ ও সাহায্য সহযোগিতার উদ্যোগ গ্রহণ করে এ মহামারীর কালে, যা এখনো চলমান আছে। তথাপি মানুষ নিজের উপার্জনের ব্যবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। কারণ এ মহামারি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন কবে হবে তা বলা অনিশ্চিত।
লকডাউনকালীন সময়ে বিশেষভাবে সংকটের শিকার হয় বেসরকারি খাতের সাথে সম্পৃক্ত মানুষ। ব্যবসা বাণিজ্যের স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত হবার কারণে অনেকের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি চাকরি হারিয়ে এখন বেকার জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণি পুঁজির অভাবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না লকডাউনের পর। সরকারের প্রনোদনা প্যাকেজ নিম্ন আয়ের মানুষের ধারণ করা সম্ভব নয় বহুবিধ জটিলতার কারণে। তাই তারা বাধ্য হয়ে জীবিকার জন্য ক্ষুদ্র আয়ের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দৈনিক আয়ের পেশার সন্ধান করছে। বাঁচার তাগিদে রিকশা চালানো বা দিন মজুরের কাজ করছে।
অন্যদিকে কোভিড ১৯ মহামারি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অনিয়ম দুর্নীতিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে জনগণের সামনে। তবে এ থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা দৃশ্যমান নয় এখন পর্যন্ত। কারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। বরং স্বল্প সময়ে বিগত সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনিয়ম চলছে ব্যবসা বানিজ্য থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে। বন্ধ হয়নি ঘুষ বানিজ্য, দুর্নীতি, অনৈতিক কর্মকান্ড। যা দেখে মনে হয়’ মানবিকতা ‘শব্দটি ছিল কেবল সাময়িক সময়ের জন্য।
প্রাত্যহিক জীবনে করোনাভাইরাস আছে কি নাই তা আর এখন আলোচ্য বিষয় নয়। নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সকল স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষ চলাচল করছে প্রাত্যহিক জীবনে। এদেশে করোনাভাইরাস নামে কিছু ছিলো তা বুঝা অসম্ভব হয় রাস্তা ঘাটের পরিস্থিতি দেখে ।
বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় হলো, মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস টেস্ট করার তেমন কোন আগ্রহ নেই। এমনকি সরকারিভাবেও প্রত্যেক মানুষের কোভিড-১৯ টেস্টের তেমন কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অথচ অন্যান্য দেশে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
করোনা পরর্বতী সময়ে ব্যয় সংকোচনের নামে বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে প্রায় প্রতিটি সেক্টরে। যা অনেকেরই পারিবারিক জীবনে বিষাদের ছায়া হয়ে নেমে আসছে। কার চাকরি কখন যায় সে আতংকে কাটচ্ছে দিন।
যে মানবিকতা কথা বারবার উঠে এসেছে লকডাউনের সময়, তা এখন ভুলতে বসেছে সবাই। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঁচার লড়াই থেকে জরুরি হয়ে উঠেছে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চিন্তা। তাই করোনা পরর্বতী জীবনে মানুষের মাঝে আত্মসংশোধন নেই। বরং লোভাতুর মনের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন কার্যকলাপে। সে সাথে প্রমাণিত হচ্ছে প্রকৃতি তার বিধান দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করতে পারেনি। কারণ মানুষ অর্থ ও ক্ষমতার দাম্ভিকতা নিয়ে দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে। আর মানবিক ভাবনা সে দাম্ভিকতার লেবাস মাত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)