‘ওরা ১১ জনের কেউ কেউ ভুল বুঝেছিল’

জাফরের ঘিলু সিঁড়িতে কালচে হয়ে ছিল শুকিয়ে যাওয়া রক্তে। অথচ ওখানে আমার ঘিলু থাকার কথা ছিল। ২৫ মার্চ রাতে টেকনাফ থেকে ইকবাল হলে ফিরে এসেছিল জাফর, যুদ্ধ করবে পাকিস্তানীদের সঙ্গে এই ভেবে। আর আমি ভাই-ভাবীর অনুরোধে সে রাতে ফিরেছিলাম গোপীবাগের বাসায়। সম্ভবত ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে। মাঝরাতে হামলা করল পাকিস্তানী বাহিনী। ইকবাল হল, রাজারবাগে। গোপীবাগে বসে শুনছি গুলির শব্দ চারপাশে। যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে ফিরে ইকবাল হলে যাই। যেটা আজকের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। হলের দারোয়ান মামা দেখালেন জাফর আলমের সে দৃশ্য। জানালেন, আজাদ পত্রিকায় কাজ করা চিশতীকে গুলি করে সবার শেষে মেরেছিল পাকিস্তানী বাহিনী সে কথা। বললেন, মামা আপনারা অনেকে আসলেন ফিরা, অনেকে তো আসলো না। সে কথাটা মাথায় ঘুরছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক ইত্তেফাকের ‘রুপবাণী’তে থেকে সিনেমা বিষয়ক লিখতাম। নিজে ‘নূপুর’ নামে মাসিক পত্রিকা বের করতাম। অনেকে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে থাকেন।  সেখানে মূল উদ্দেশ্য মুহূর্তগুলোকে নিজের ক্যামেরায় ধারণ করা। ঠিক তেমনি আমিও মূলত যুদ্ধের মুহূর্তগুলোকে ধারণ করে রাখতে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। সে ঘটনাগুলোকে মালার মত করে গাঁথতে চেয়েছিলাম। সে সময় সম্ভবত ‘চিত্রালী’তে মাসুম ইয়াহুদী নামে একজন লিখত। এমন ভাবে লিখতেন চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মানুষকে ধরে, যে মনে হত তিনি ঘটনাস্থলে আছেন। অথচ যাকে নিয়ে লিখছেন সে বুঝত কিন্তু তার নাম দেওয়া থাকতনা। পরে জানলাম যে লিখছেন সে বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার আল মাসুদ। চাষীর মাধ্যমে তার কাছে গেলাম। চাষী নজরুল ইসলাম-এর মাধ্যমে আমি তার সঙ্গে পরিচিত হই। তখন আমি আল মাসুদকে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার গল্পগুলো শুনাই। তিনিই পরে আমার ছোট ছোট ঘটনার ফুলগুলোকে একসঙ্গে মালায় গেঁথে দিয়েছেন।

এবং ‘ওরা ১১ জন’ : ১১ জন যে যোদ্ধা ছিল চলচ্চিত্রে তাদের মধ্যে একজন শুধু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেননা। তার নাম আলতাফ। তিনি খ্যাতিমান অভিনেতা ছিলেন। যদিও যুদ্ধে যাননি তবে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘এতটুকু আশা’র মত চলচ্চিত্র করেছেন। একটি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র ছিল যে যুদ্ধে পা হারাবে। এমন অভিনয় সমৃদ্ধ চরিত্র প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে করা যেতনা বলে মনে করে তাকে নেওয়া হয়। বাকী সবাই ছিল মাঠের যোদ্ধা।  খসরু, ফিরোজ,  নান্টু, মুরাদ, অলিন, বেবী, আতা, আবু, হেলাল ও মঞ্জু। একেকজন একেক গ্রুপে যুদ্ধ করেছে। মূলত চলচ্চিত্রে এদের এক সুতায় গেঁথেছিল খসরু।

এই ১০ জন যোদ্ধার মধ্যে ২ জন চলচ্চিত্রে নিয়মিত হয়েছিল। একজন খসরু আর আরেকজন নান্টু। ফিরোজের সিনেমা হল আছে। চলচ্চিত্র ব্যবসায় জড়িয়েছিল ঠিক তবে রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী হয়েছিল। খসরুর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছে শিল্পী সমিতির নির্বাচনে। ওপেন হার্ট অপারেশন শেষে এখন বিশ্রামের জীবন। কাজী ফিরোজ রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ভীষণভাবে। একই দলে রাজনীতি করি। এখন সে এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ। জগন্নাথ হলের ভিপি ছিল। প্রায়ই ইকবাল হলে আসত। সে সূত্রে বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাকে মনে হয়েছিল নেওয়া যায়। নান্টু, সিদ্দিক জামাল নান্টুকে নিয়ে এসেছিল খসরু। আমার বন্ধু। এসে বলেছিল এই ছেলেটা যুদ্ধ করেছে। মাতিয়ে রাখতে পারে পুরো পরিবেশ। ওকে ‘ওরা ১১ জন’ এ নেওয়া যায়না? না করার মত কিছু দেখিনি। হেলাল ছিল মগবাজারের বড় গুণ্ডা। রাজ নামে পরিচিত ছিল। সাহসী যোদ্ধাও ছিল।  আতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। গোপীবাগেই থাকে। ভাই ভাই বলে এখনও।

নান্টু, মুরাদ, বেবী, হেলাল পৃথিবীতে নেই। আবু মানে জনি আর অলিন সম্পর্কে এখন কিছু জানা নেই। তাই কিছু বলতেও পারবনা।

যেভাবে ‘ওরা ১১ জন’ এবং… :  যারা ছবি ডিস্ট্রিবিউশন করত তারা ছবি প্রযোজনা করতনা। ছবির প্রোডিউসার যে সে বড় আর্টিস্ট সাইন করে কয়েকদিন কাজ করত। দুতিনদিন বা চার পাঁচ দিন যার সামর্থ্যে যতটুকু কুলায়। তারপর সে শুট নিয়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে যেত। স্টার, ফেমাস এরকম ১০-১৫টি বড় ডিস্ট্রিবিউটর ছিল। ‘ডিল’ হত যে ছবি মুক্তির পর তারা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে নেবে। এরপর যা লাভ হবে তার ২০ ভাগ তারা নেবে এবং বাকী ৮০ ভাগ প্রযোজক। ফলে ছবি হিট বা ফ্লপ হোক তাতে ডিস্ট্রিবিউটরের কোন ঝুঁকি ছিলনা।

তো আমি স্টার ডিস্ট্রিবিউটর এর মালিক ইফতেখার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, খসরু অভিনয় করতেছে। যুদ্ধের পরে খসরু-মন্টু নাম ছিল অনেকটা স্টার ভ্যাল্যুর মতো। বললাম খসরু আছে ছবিতে। স্টার জড়াল আমাদের সঙ্গে। পাশাপাশি বলল, কিছু তারকাকে ছবিতে নিলে তারা বেশি টাকা দিতে পারে। আমরা যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার পর যা বলব তাই হবে। রাজ্জাক-শাবানাদের কাছে তারপরও ভয়ে ভয়ে যাওয়ার পর তারা বিনা পয়সায় কাজ করে দিতে চেয়েছে। কে কাজ করতে চায়নি ‘ওরা ১১ জন’ এ। মুস্তাফিজ সাহেব এই চলচ্চিত্র বিনা পয়সায় পরিচালনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম চাষী নজরুলকে দিয়ে কাজ করাব। কারণ তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম। নিজের কথার বরখেলাপ করতে চাইনি। এসএম শফির প্রধান সহকারী ছিলেন চাষী। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন। কিন্তু তিনি কোনদিন ছবিটির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার নাম নেননি। চাষী নজরুল ইসলামকে মাসে ৫০০ টাকা দিতাম। তখন ১০০ টাকায় ১ ভরি সোনা মিলত। বলেছিলাম, আপনার অন্য দিকে মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই। ছবিটায় মনোযোগ দেন। টাকা আপনার স্ত্রীর হাতে দিয়ে আসব। সে আমার ক্লোজ বন্ধু ছিল। তার ওপর কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছিলাম।

অনেকে এমন ভাবে বলতেন যেন চাষী পরিচালক হয়েই এসেছিল। অথচ সহজ বিষয় এই যে, প্রযোজনা না করলে ছবিটি কি করে হতো? এমনও বলতে শুনেছি, এত টাকা মাসুদ পারভেজ কোথা থেকে পেল। চাষী, খসরু এরাও হয়ত টাকা দিয়েছে। একদম না। মায়ের কাছ থেকে, ছোট বোন, তার হাজবেন্ড, আমার বই লেখা আর পেপার বের করার টাকা নিয়ে ‘ওরা ১১ জন’ এর কাজ শুরু করেছিলাম। সে টাকা ফুরিয়ে আসার কিছুদিন আগে স্টার এর সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি হয়। ফলে পুরো কাজ করতে কোন অসুবিধা হয়নি। আমার ৫৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল সব মিলে।

ছবিটি রিলিজের আগে চারপাশে ছড়িয়ে গেল যে ছবিটি ব্যবসা করবে। তবে মুক্তির আগে যে ১১ জনের মধ্যে ৫-৬ জন মুক্তিযোদ্ধা, যারা ছবিতে ছিল, তারা কিছুটা ভুল বুঝেছিল। এ ভুল বোঝাটা মূলত প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলামের স্ত্রীর মাধ্যমে হয়েছিল। যদিও সেটা পরে কেটে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। ওরা বলে, ‘বন্ধু তোমার যে খরচ হয়েছে সে টাকাটা নিয়ে যাও। তারপর লাভ আরও ১ লাখ টাকা নাও। তারপর যদি কিছু থাকে তবে আমাদের কিছু দিও। যদি আমরা এখানে কাজ না করে অন্য কিছু করতাম তাও তো কিছু আয় হতো।’ আমি তাতে দোষের কিছু দেখিনি। অন্যায় মনে হয়নি ওদের চিন্তা। কারণ তারা তো অভিনয় করেছিল। দেড় দুই মাস যে  তাদের তো প্রাপ্য রয়েছে।

চাষীকে বলেছিলাম, আপনার কি চাওয়া? তখন তিনি বলেছিলেন, খসরুর কাছে দিয়ে দিলেই হবে। ইফতেখারুল আলম এখনও বেঁচে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সত্যাসত্য মিলবে। তাকে বলেছিলাম, আমার ভাগে যে টাকা থাকবে তার ৪০ পার্সেন্ট খসরুদের দেবেন। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আপনি জানেন আপনি কত টাকা লস করছেন। আমি বলেছিলাম, লস কোথায়? দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসেবে আমার নাম থাকবে। যে টাকা খরচ করেছি তা তো ফিরে এসেছেই। এর দ্বিগুণ লাভও নিয়েছি। তারপর যা আসছে সেখান থেকে ৪০ পার্সেন্ট দিচ্ছি সেটাতো খুব বেশি না। যাহোক, খসরুর লোকজন ১০ জনের টাকা নিয়ে যেত। তবে কয়েকজনকে হয়ত টাকা খসরু ঠিক মত দেয়নি। একদিন ফিরোজ বলল, দোস্ত তুই বলে সবাইরে টাকা দিতেছস। কই আমি তো কিছু পাইনাই। তখন সাথে থাকা ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আতা নামে একজন ছিল তাকে ১৫ হাজার দিয়েছিলাম। পরে চাষী বলতেন যে, আমাকে কোন পেমেন্ট দেওয়া হয়নাই। সরাসরি তাকে একবারে কোন টাকা দেইনি এটা সত্য। মাসে ৫০০ টাকা করে দিতাম। পরে যে টাকাটা তাকে দেওয়ার কথা ছিল সে নিজে বলেছিল খসরুকে দিলে হবে। এখন খসরু যদি না দিয়ে থাকে সেটা কি আমার দোষ?

‘ওরা ১১ জন’ আমাকে সব দিয়েছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। কিছু অভিমানও দিয়েছে। দিয়েছে কষ্ট। অভিমান এবং কষ্টগুলো নিজের থাক। রাষ্ট্র এতদিন বোঝেনি। বোঝাতেও চাইনা।

ছবি : সাকিব উল ইসলাম ও ওবায়দুল হক তুহিন

ওরা ১১ জন