এতো কাছে, তবু কত দূর!

বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বকাপে কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে? নিরাপদ উত্তর হবে, ইংল্যান্ড অথবা নিউজিল্যান্ড। গত কয়েকবছর ধরে ভালো ক্রিকেট খেলার জন্য অবশ্য এই উত্তর না। বরং, দুটি দল এখন বিশ্বজয়ী হওয়া থেকে মাত্র নিঃশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য।

লর্ডসে এক দলের নিশ্চিত হাসির সুযোগ থাকলেও বিশ্বজয়ের মঞ্চে বসে থাকাদের ক্রিকেট দুনিয়ায় স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সাতটি দেশকে বিশ্বকাপের জন্য আমন্ত্রণ জানায় ইংল্যান্ড। ওই দলগুলোর মধ্য পশ্চিম আফ্রিকার একটি দলও ছিল। যে দল গঠিত হয়েছিল কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার মতো দেশগুলো থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে।

স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড গ্রুপপর্বে একই গ্রুপে ছিল। কিন্তু গ্রুপপর্বের সেই লড়াই মোটেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না। বরং ৬০ ওভারের ম্যাচে কিউইদের ১৮৬ রানে আটকে রেখে একতরফাভাবে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ইংলিশরা। এখন অবশ্য সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

গ্রুপপর্বে হারলেও ইংল্যান্ডের সঙ্গে শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছিল নিউজিল্যান্ডও। সেমিতে অবশ্য দুদলই ছিটকে যায় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে। সেই যে দুদলের বিশ্বকাপ যন্ত্রণার শুরু, তা এখনো অব্যাহত।

চার বছর পর আবার যখন ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হয়, তখন অবশ্য প্রথম দেখার চেয়ে অনেক বেশি টাইট ম্যাচ হয়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের ক্লাসিক সেমিফাইনালে ২২২ রানের টার্গেটে ১০ রান আগেই থেমে যেতে হয় কিউইদের। কিন্তু ফাইনালে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয় স্বাগতিকদের।

১৯৮৩ বিশ্বকাপ ছিল নিউজিল্যান্ডের জন্য আরও পীড়াদায়ক। ইমরান খানের পাকিস্তানের কাছে হেরে বিদায়। খানের ৭৪ বলে ৭৯ রানের ইনিংসের কাছেই মূলত ধরাশয়ী হয় তারা। কিন্তু কিউইদের কাছে গ্রুপপর্বে হেরে সেমিফাইনালে যায় ইংল্যান্ড। কিন্তু টানা দ্বিতীয় ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় ইংলিশরা।

ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ফাইনাল হারের সঙ্গে বিশ্বকাপ ইতিহাসেরও একটি যুগের সমাপ্তি ঘটে। যেটা পরপর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল ইংল্যান্ডেই। নতুন চ্যাম্পিয়ন ভারত তখন নিজেদের সমর্থকদের কথা তুলে ধরে বিশ্বকাপ উপমহাদেশে আয়োজনের আবদার জানায়।

আয়োজক ও ভেন্যু পরিবর্তন হলেও নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারতের অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ বিশ্বকাপে একমাত্র জিম্বাবুয়েকে ছাড়া আর কোনো দলকে হারাতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। ফলে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়। অপরদিকে, দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড। কিন্তু অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়ার কাছে মাত্র ৭ রানে হেরে আবারও স্বপ্নভঙ্গ।

থ্রি-লায়ন্সদের আর্তনাদটা আরও বাড়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপে। ১৯৮৩ সালের মতোই ইমরান খানের দলের কাছে হেরে বিদায় নেয় নিউজিল্যান্ড। আর টানা দ্বিতীয় এবং সবমিলিয়ে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ‘জাদুকর’ ইমরান খানের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, সেইসঙ্গে তার শিষ্য ওয়াসিম আকরামের সুইং গোলায় আবার ছিন্নভিন্ন ইংল্যান্ডের স্বপ্ন।

তারপর ২৭টি বছর, সাদা বলের বড় মঞ্চ থেকে দূরেই থেকেছে ইংল্যান্ড। টেস্ট ক্রিকেটে বহু উন্নতি করলেও আরেকটি সেমিফাইনালে পৌঁছার জন্য অপেক্ষা করতে হল ২০১৯ পর্যন্ত। তবে, এই সময়ে কিউইরা কিন্তু বেশ কয়েকবারই ওই পর্যন্ত গিয়েছিল।

১৯৯২’র পর ১৯৯৯তেও সেমিতে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। সেবারও পাকিস্তানের কাছে হেরে বিদায়। এরপর ২০০৩ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড কেউই গ্রুপপর্ব টপকাতে পারেনি।

চার বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজে আরও শক্তিশালী হয়ে বিশ্বকাপে নামে নিউজিল্যান্ড। গ্রুপপর্বে শেন বন্ডের তাণ্ডবে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শেষ চারে জায়গা করে নেয় তারা। বন্ডের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের শূন্য খাতায় সাজঘরে ফেরার ছবি এখনো ক্রিকেট গ্যালারিতে ভাসে। কিন্তু এবারও হল না। সেমিতে এবার কিউইদের কাঁদায় মাহেলা জয়াবর্ধনের শ্রীলঙ্কা।

২০১১ বিশ্বকাপ নিউজিল্যান্ডের আগের বিশ্বকাপের রিহার্সেল যেন। সেমিতে আবার সেই লঙ্কানদের কাছেই আটকে যায় কিউইরা। আর ইংল্যান্ড বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনালে আয়ারল্যান্ডের রেকর্ড রান তাড়া করে জেতার পর।

ছয়বার সেমিতে ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে সফল হয় নিউজিল্যান্ড। ২০১৫তে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে তারা। অনেক প্রাপ্তির বিশ্বকাপ তারা শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৯৩ রানের স্কোর দিয়ে। যে ম্যাচে আবার বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড গড়েন মার্টিন গাপটিল। অন্য ম্যাচে পরে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডকে তারা হারিয়ে দিয়েছিল ৩৭ ওভারের বেশি হাতে রেখে।

গ্রুপপর্বে অস্ট্রেলিয়াকেও হারায় নিউজিল্যান্ড। ফর্মের তুঙ্গে থাকা ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল তখন চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরে। কিন্তু এবারও হল না। ফাইনালে তাসমান প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার সামনে মেলবোর্নে নিজেদের খুঁজেই পেলেন না তারা।

এবার আবারও স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কিউইদের যে দল মাঠে নামতে যাচ্ছে, সেই দলের ছয়জন খেলোয়াড় আছেন যারা বিশ্বকাপের ফাইনাল কী জিনিস জানেন। কারণ, গাপটিল-টেলর, উইলিয়ামসন-বোল্ট, হেনরি-সাউদি, তারা সবাই আগের ফাইনালে ম্যাচের সদস্য।

রোববার আরেকবার ক্লান্তিকর এবং হতাশার অপেক্ষা দূর করতে ব্যাট-বলের সঙ্গে তাদের মানসিক শক্তিটা চালিয়ে যেতে হবে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডকে। সেটা হলেই ক্রিকেটের নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠবে তাদের যেকোনো একদল।

বিশ্বকাপ-২০১৯