‘থাপ্পড়’ আর ‘পেটানোর’ ঘোষণা দিয়ে কিছু সময়ের জন্যে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন একজন শিক্ষাবিদ, উপাচার্য। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। ড. চৌধুরী জীবনে একবার হলেও ‘পেটাতে চান’ সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতিকে। বিষয়টিকে সাধারণভাবে দেখা হলেও আদতে সেটা নয়, ভয়াবহ ঘোষণা ত বটেই!
উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী গত ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু পরিষদের আলোচনা সভায় অবাক করা এমন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘এস কে সিনহাকে যদি কোথাও পাই, আমি দুটো থাপ্পড় দিয়ে ছাড়ব। আমি দেবই। কেউ আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। শয়তানকে যেভাবে পাথর মারে, সেভাবে পাথর মারব। জীবন দিয়ে হলেও সেটা করব।’
উপাচার্য মহোদয় জ্ঞান-গরিমায় প্রাগ্রসর জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বই কেবল নয় নেতৃত্বও দিচ্ছেন। তার পদ-পদবি সে কথাই বলে, কিন্তু এমন সম্মানীয় অবস্থানের একজন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধান এমন শ্রুতিকটু শব্দ-বাক্য-ভাষা ব্যবহার করেন তা অবিশ্বাস্যই মনে হয়। তবু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি এমন করেছেন, এবং দম্ভ নিয়েই করেছেন। সাংবিধানিক পদে থাকা সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিকে প্রকাশ্যে থাপড়ানোর ঘোষণা দিয়ে তিনি অপরাধও করেছেন।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি কেবল একটা পদবিই নয়, এটা প্রতিষ্ঠানও। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তিনি নিশ্চিতভাবেই অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কিন্তু তিনি যা করলেন সেটা কোনোভাবেই অনুকরণযোগ্য নয়, রীতিমত সুবিবেচনা পরিপন্থি।
এসকে সিনহার সঙ্গে দেশের অনেকের শত্রুতার বিষয়টি রাজনৈতিক। বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত হওয়া বিষয়ক সংবিধান সংশোধনীর বাতিলের রায় আওয়ামী লীগ সরকার ভালোভাবে নেয়নি বলে দ্বন্দ্বটা সবখানে ছড়িয়েছে। সংবিধান সংশোধনীর বিরুদ্ধে এই রিট হাই কোর্টে বাতিল হলে সেটা আপিল বিভাগে বহাল থাকে। আপিল বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন সেসময়ের প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। মূল রায়ে উল্লেখ তার কিছু পর্যবেক্ষণ সরকারের মনঃপুত হয় নি। সাংসদ, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্যসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাক-আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাকে পেটানোরও হুমকি দিয়েছিলেন অনেকে, দেশছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয় প্রকাশ্যে। এরপর নানা ঘটনা শেষে এসকে সিনহাকে ছুটি নেওয়ার নামে দেশই ছাড়তে হয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সাংবিধানিক পদে থাকাবস্থায়ও তাকে নানা রকমের হুমকি দেওয়া হলেও এটাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয় নি। এখন দেশেই নাই তিনি, নাই প্রধান বিচারপতি পদেও তাই পুরনো রাজনৈতিক আক্রোশ বুঝি ঝাড়লেন চবি উপাচার্য, সুযোগ পেয়েই।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে অন্য কিছু অভিযোগ এনে উপাচার্যের আরও দাবি, ‘বাংলাদেশকে নিয়ে সাবেক বিচারপতি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত করছেন। ৬ দিন আগে তিনি যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলীর ছোট ভাই মামুনের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎ করে মামুনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করছেন। এটা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে।’
এ অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে, অথবা তাৎক্ষণিক প্রমাণিত হয় নি। তাছাড়া শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিল যে আপিল বেঞ্চ সেখানকার নেতৃত্বে ছিলেন এসকে সিনহাই, এবং তার ব্যক্তিগত রায়ে মীর কাসেমকে ফাঁসির রায় দিয়েওছিলেন। যার রায়ে ফাঁসির রজ্জু ঝুলল মীর কাসেমের গলায় সেই বিচারপতির সঙ্গে তার পরিবারের সুসম্পর্কের যে অভিযোগ সেটা প্রাথমিকভাবে মিথ্যা মনে হয়, তবু অপেক্ষা করছি প্রমাণের। আশা, ইফতেখার চৌধুরী অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণও দেবেন।
মৌলভীবাজারের সন্তান এসকে সিনহা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। উপাচার্যের দাবি, তবুও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি ‘বেইমানি’ করেছেন। এ প্রসঙ্গে উপাচার্যের ভাষ্য, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে না জানিয়ে ১৭ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করেছিল ১০টি মেডিকেল কলেজ। আদালত সেই কলেজগুলোকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে। এই টাকা ঢাবি পেয়েছে। চবিকে না জানিয়ে পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ছাত্র ভর্তি করে। তাই জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা আমরা (চবি) পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা পাইনি। কারণ, এস কে সিনহা চবির তিন কোটি টাকা বেসরকারি কোম্পানি কনকর্ডকে দিয়েছেন। পরে আমরা অবশ্য আদালতের নির্দেশে দুই কোটি টাকা পাই। সেই টাকায় এখন মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করা হচ্ছে।’
কনকর্ডের ক্যান্সার হাসপাতাল আছে যেখানে এ টাকা দেওয়া হয় বলে উল্লেখও করেছেন উপাচার্য। তবে কনকর্ডের দুর্নীতি ও জালিয়াতির প্রমাণ দুদক পেয়েছে বলে তথ্য উপাচার্যের।
এটা সকলের জানা যে জরিমানালব্ধ অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার রীতি রয়েছে, এটা নজিরবিহিন নয়। এক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে হয়ত, কিন্তু পুরনো সেই ঘটনাকে ফের উপস্থাপন করে প্রবল আক্রোশে আক্রমণের ঘোষণা দেওয়াটা কতখানি সুবিবেচনার সেটাও বিবেচনা আর আলোচনার দরকার রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি থাকায় উপাচার্যদের অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, অথবা তাদের কর্মকাণ্ডে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়ে আসছেন। এ প্রসঙ্গে বেশিদূর আলোচনা নিয়ে যেতে চাই না, উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামানের নামই কেবল উল্লেখ করছি যিনি স্রেফ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তার কিছু ছাত্রকে ‘জঙ্গি’ আখ্যা দেওয়াটা পর্যন্ত বাদ রাখেননি। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে তাকে ভিন্ন বক্তব্যও দিতে হয়েছে।
শিক্ষকদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের আপত্তির কিছু নাই। শিক্ষকেরাও তাদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগে রাজনীতি করতে পারেন, যেকোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থকও হতে পারেন; কিন্তু এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক বিশ্বাস যখন তার অবস্থান-দায়িত্বকে অতিক্রম করে তখন এনিয়ে আমাদের বক্তব্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা তাদের ভুল অবস্থানকে তখন সমর্থন করি না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে থাপ্পড় মারা বিষয়ক যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা তার শিক্ষক মর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক; এটা তিনি করতে পারেন না। তার এই বক্তব্যে আমরা আশাহত। আমরা আশা করব তিনি তার দেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য থেকে সরে এসে আত্মসমালোচনামূলক ভুল স্বীকার করবেন।
ভুল মানুষেরই হয়, ড. চৌধুরীও মানুষ; এ বিশ্বাস নিয়েই পথ চেয়ে আছি একটা আত্মসমালোচনা-আত্মশুদ্ধির। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে সেটাই প্রত্যাশিত!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)