উত্তরাধুনিক রেস্তোরাঁয় মানুষের মাংস

ভুল বুঝবেন না! আসলে বলতে চেয়েছি, উত্তরাধুনিককালে মানুষের মাংস খাওয়ার ধরন কিংবা রূপান্তরটা কেমন হয়েছে। আদৌ কী মানুষ মানুষের মাংস খায়? গল্পগ্রন্থ ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’র লেখক মোজাফ্‌ফর হোসেন একটি সাক্ষাৎকারে এর উত্তর দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, উত্তরটা আমার মনের মতো হয়েছে অথবা ভাবতে পারেন— আমিও তেমনই ভেবেছিলাম বইটি পড়ে। মোটাদাগে মনে করি, মানুষ মানুষের মাংস খায়, একটি রাষ্ট্রের গোটা সিস্টেমটাই বেঁচে থাকে মানুষের মাংস খেয়ে। এটা এলিগরিক্যাল। জটিল গোলকধাঁধা। গল্পকার মোজাফ্‌ফর হোসেন যেটা সুনিপূণভাবে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি গল্প বলেন একটু ভিন্নভাবে, যেটা বাংলা সাহিত্যে ইতোমধ্যে জায়গা পাকা করে নিয়েছে। এইসব গতানুগতিক কথাবার্তা বলে সেটা প্রকাশ করা সম্ভব নয় বরং উত্তরাধুনিক কিংবা জাদুবাস্তববাদের আলোকে কিছুটা বিশ্লেষণ সম্ভব হলেও হতে পারে।

একুশটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটির প্রায় সবকটি গল্পের ভেতরেই প্যারানাইয়া কিংবা ব্লাক হিউমর অথবা আয়রনির ব্যবহার লক্ষণীয়। বিষয়টা এমন যে আয়রনির মতো কৌতুকপূর্ণ ব্যাপারের সাথে ব্লাক হিউমর অথবা প্যারানাইয়ার মতো সিরিয়াস বিষয়ের সংমিশ্রণ। যেমন, ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন— খুনির দুটো হাতই নাই; মুক্তিযুদ্ধের সময় যার দুটো হাতই কেটে নিয়েছে পাকিস্তানি রাজাকার। এখন তাকেই কিনা আসামি করা হয়েছে এলাকার বিত্তবান চেয়ারম্যানকে খুনের অপরাধে। এই গল্পের ভেতর আয়রনি আছে। কিন্তু পাঠক যতই গল্পটির ভেতরে লুকানো আরও যে গল্পগুলো আছে সেগুলোর গভীরে প্রবেশ করবে, ততই সিরিয়াস হয়ে উঠবে— গল্পটি শেষতক উন্মোচন করবে ক্ষমতা ও তার অপব্যবহার এবং অবক্ষয়। গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠকের লাতিন আমেরিকার লেখক হুয়ান রুলফোর ‘বুড়ো এস্তেবান’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যেতে পারে। এই গল্পগ্রন্থে প্রতিটি গল্পের ভেতরই রয়েছে বীভৎসতা কিংবা বীভৎস রস, যেটা প্যারানাইয়ার অনুরূপ।

বলে নেয়া ভালো, গল্পগ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হতে পারে— লেখক ইতিহাস সচেতন। মনে হতে পারে, গল্পের ছলে লেখক যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস লিখছেন। লিখছেন কিছু সিজোফ্ফে‌নিয়ায় আক্রান্ত মানুষের বয়ানে। তাই তারা অবলীলায় ধর্ষণকে উৎযাপন করতে পারেন, মানুষের মাংস খেতে খেতে হিউম্যান রাইটস নিয়ে কথা বলতে পারেন, স্মৃতিভ্রষ্টের মতো ঠিকানাহীন ঠিকানায় চিঠি লিখতে পারেন; এমনকি খুন হয়ে গিয়েও আফসোস করতে পারেন এই বলে যে, এমনভাবে খুন হওয়া অর্থহীন— যে খুনের খবর ভাইরাল হওয়ার মতো নয়! গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘একশ বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসটা যারা পড়েছেন, তারা জানেন যে, এই উপন্যাসের একটি পর্বে দেখানো হয় মাকোন্দ গ্রামের সকলেই স্মৃতিভ্রষ্ট রোগে আক্রান্ত হন এবং তারা ভুলে যেতে থাকেন পূর্বের সকল স্মৃতি, তাই তারা গাভীর গায়ে লিখে রাখেন: ‘এটা গাভী, দুধ দেয়।’

মোজাফ্‌ফর হোসেন প্রণীত ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোও তেমন স্মৃতিভ্রষ্টের মতো আচরণ করে। আমার একটি প্রবন্ধে বলেছিলাম: বাঙালিরা আসলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তারা হিন্দু, মুসলমানের চক্রব্যূহের ভেতরেই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছেন, ফলত সমস্যা হচ্ছে পূর্ববঙ্গে যারা নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তাদের সংস্কৃতি বলে আর কিছু থাকে না, আমদানিকৃত কিছু খেজুরে মালমসলা নিয়ে তারা উন্মাদনা প্রকাশ করেন, যা হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর।

এই জাতি মূলত স্মৃতিভ্রষ্টেরই অনুরূপ। যেটা গল্পগ্রন্থের ‘স্পাই’ শিরোনামের গল্পটিতে উঠে এসেছে। গল্পটি বলা হয়েছে একটি শিশুর বয়ানে— নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে। মূলত যাত্রাপালা, নাচ-গান-মেলার মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো ধর্মীয় এজেন্ডা দিয়ে বন্ধ করে দেয়ার পর বাংলায় সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ফলে নির্মমতাই হয়ে উঠেছে মানুষের উৎসবের বিষয়। তাই নিরীহকে নিপীড়ন করে এরা আনন্দ পায়, খুন হতে দেখলে আনন্দ করে সেলফি তোলে, গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মারে অসহায় মহিলাকে। শিশু বলৎকার অথবা ধর্ষণের কোনো বিচার হয় না।

‘শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে’ গল্পটিতে মোজাফ্‌ফর দেখিয়েছেন, মাথাহীন মানুষের রাষ্ট্রে কীভাবে মানবতা ভেঙে পড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বীভৎস বিশৃঙ্খলা। কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পটির শুরুর মতো এই গল্পটিরও প্রথম বাক্য হচ্ছে: ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা যেমন দেখছেন সে রূপান্তরিত হয়েছে একটি পোকায়, তেমনই মোজাফ্‌ফর দেখছেন কেবল তারই মাথা আছে, আর কারো মাথা নেই! মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্পগুলো ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধেও এক জোরালো প্রতিবাদ। তিনি ‘মসজিদ’ শিরোনামের গল্পটিতে দেখিয়েছেন ক্ষমতাবানেরা কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ নিরীহ জনগণকে শোষণ-নিপীড়ন করে।

মোজাফ্‌ফরের গল্পের ভাষা সমসাময়িক মানুষের মুখের ভাষা। একারণে তার গল্পপাঠ হয়ে ওঠে সমকাল পাঠ, তিনি সময়কে খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। তার গল্পে পোস্টমডার্ন এবং জাদুবাস্তববাদের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। উত্তরাধুনিক তত্ত্বের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: গল্পের চরিত্ররা মাঝে মাঝে সরাসরি লেখকের সাথে কথা বলেন এবং গল্পের বাঁক বদল করে দেন, লেখকের আর সেটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে না, ফলে একটা গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ে অন্য আর একটা গল্প। বইয়ের ‘বেকার জীবনের অপঠিত গল্প’ শিরোনামের গল্পটিতে যেটা পাঠক উপভোগ করবেন।

ক্ষেত্রবিশেষে মোজাফ্‌ফরের গল্প পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে তিনি সংবাদ প্রতিবেদন পড়ছেন; এটাও পোস্টমডার্ন জনরা। ‘খুনের সংবাদ ধরাতে’ তেমনি একটি গল্প। এই ধরনের গল্পগুলো কিছুটা গল্পহীন গল্পের মতো, এধরনের গল্পে লেখকের আবেগটা বোঝা যায় না, এমন নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে গল্পগুলো বলার একটা বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, খুব সহজেই অনেক কথা বলে দেয়া যায়, আর পাঠক নিজের মতো করে গল্পের ভেতরের গল্পগুলো বিনির্মাণ করার স্পেস পায়।

আর জাদুবাস্তববাদ হচ্ছে লাতিন আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি শিল্প-মতবাদ, যেটাকে আসলে মতবাদ কিংবা তত্ত্ব বলাও যায় না। জাদুবাস্তবাদ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাস্তবতার ভেতর জাদুকে প্রতিষ্ঠা করা, জাদুর ভেতর বাস্তব নয়। জাদুর ভেতর বাস্তব প্রতিষ্ঠাকে বলে ফ্যান্টাসি। জাদুবাস্তবতায় অবাস্তব ঘটনাকে প্রতিষ্ঠা করতে হয় প্রয়োজনীয় বর্ণনা দিয়ে। যেটা পাঠক উপভোগ করবেন ‘পুনরুত্থান’, ‘শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে’ প্রভৃতি গল্পে। মার্কেসের ‘বিশাল ডানাওয়ালা থুরথুরে বুড়ো’র মতো এই গল্পেও চরিত্রকে ঘিরে জমে ওঠে মজমা, আর পাঠক চিনে নেন মানুষ, মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং সমাজ বাস্তবতা।

সত্যি বলতে কি, এতো সহজ করে লেখক মোজাফ্‌ফর হোসেন কিংবা তার গল্পগুলোর বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব, আমি সেই ভুলে পা দিচ্ছিও না। সুতরাং পাঠক ধরেই নিতে পারেন, লেখাটা অসম্পূর্ণ। আর যে বিষয়টি পাঠককে বারবার নাড়া দেবে সেটা হচ্ছে, পূর্বের সাহিত্য। মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্পে পূর্বের বিভিন্ন সাহিত্যের অংশ যত্রতত্র হানা দেবে। সেটার ঝোঁকটা লাতিনের সাহিত্যের দিকেই বেশি, ফলে এই লেখক যে লাতিন সাহিত্যদ্বারা প্রভাবিত, পাঠকের সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

মোজাফ্‌ফরের গল্পে তাই জাদুবাস্তববাদ, পরাবাস্তব, অধিবাস্তব, সর্বোপরি পোস্টমডার্ন ভীষণ সাবলীলভাবে একাকার হয়ে যায়। তিনি দক্ষ খেলুড়ের মতো তার গল্পের চরিত্রদের মানুষের কাটা মাথা দিয়ে ফুটবল খেলান। ‘যে জীবন ফুটবলের’ গল্পটিতে উঠে আসে সমাজের এমনকিছু চরিত্র যাদের মূলত ভবিষ্যৎ বলা হয়, মানে চরিত্রগুলো কিশোর। কিন্তু তারা এতটাই নেশাগ্রস্থ যে ফুটবল খেলার জন্য স্বজনদের গলা কাটতে শুরু করে। কিছুটা ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতো। তাছাড়া গল্পটি পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে এই খেলায় যেন ক্ষমতাসীন লোকেরা সকলেই ভীষণ দক্ষ।

সর্বোপরি বলা যায়, ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ বইটিতে লেখক মোজাফ্‌ফর হোসেন সমাজের সেইসব অন্ধকারের ভেতর আলো ফেলেছেন যেটা প্রায় সকলেই অবগত অথচ কারো কিছুই বলার ক্ষমতা বা সাহস নেই। কেননা ডিজিটাল সুরক্ষা আইন! যে আইনের ফাঁদে ফেলে নিরীহকেও অপরাধী হিসেবে জেলে ঢোকানো যায়। বাক-স্বাধীনতা নিয়ে এই বইয়েও চমৎকার একটি গল্প আছে, কিন্তু সবকিছুই যদি আপনাদের সামনে খুলে-টুলে দেখিয়ে দিই তাহলে আপনারা একটি অসাধারণ বই পড়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনারা বইটি কিনুন এবং পড়ুন আর দুর্দান্ত একটি বই পড়ার আনন্দ উপভোগ করুন।

মোজাফ্‌ফর হোসেন-এর ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স।

আলোচক: কবির মুকুল প্রদীপ (কবি-প্রাবন্ধিক-নাট্যকর্মী ও নৃত্যশিল্পী)

অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁমোজাফ্ফর হোসেন