ইসির আগুন নিয়ে খেলা

নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত দেশে আগুন নিয়ে খেলাটা খেলে গেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জনসমাগম এড়িয়ে চলা আর নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে যখন সরকারি নির্দেশনা ছিল সেই সময়ে দেশের তিনটি সংসদীয় আসনে ভোটগ্রহণ করেছে ইসি। এই নির্বাচনগুলো প্রত্যাশিতভাবেই জনগণ বর্জন করেছে। ভোটপ্রদানের হার লজ্জাজনক পর্যায়ে। সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনেও এমন হতাশাজনক ভোটের হার ছিল, তবু কাগজেকলমে এমন শোচনীয় অবস্থার ছিল না। এই নির্বাচন অনুমিতভাবেই মানুষ বর্জন করেছে। কেবল তা-ই নয়, ভোট গ্রহণের এই সিদ্ধান্তকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, সমালোচনা করেছে এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তেরও।

কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনিতেই আলোচিত-সমালোচিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিতর্কিত। অভিযোগ ছিল পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন গ্রহণের ব্যর্থতার কারণে। সমালোচনা ছিল দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের কারণে। অবশ্য এই অভিযোগ কেবল অভিযোগ পর্যায়েই থাকেনি, খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) একটা পর্যায়ে এই রাতের ভোটের ব্যাপারটি কবুল করেছেন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি আগে বলেছেন ইভিএম ভোট হলে রাতে ভোট হবে না। ফলে রাতের ভোট যে মিথ্যা কোন ঘটনা সেটা সিইসির বক্তব্যেই প্রমাণ হয়। যদিও তিনি সরাসরি অভিযোগের জবাবে বরাবরই এটা অস্বীকার করেছেন, তবে অন্য এক ব্যবস্থার (ইভিএম) প্রতিষ্ঠায় তিনি সেটা স্বীকারই করেছেন।

নানা কারণে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন ভাবমূর্তি সঙ্কটে। এই ভাবমূর্তি সঙ্কটের অবস্থা থাকলেও তিনি বরাবরই সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মাঝে অজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নন। বলা যায়, একপ্রকার প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে আসছেন; যদিও সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি এসকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অনুশীলিত বাস্তবতায় যেকোনো সাংবিধানিক পদাধিকারকেও সরকারের আনুকূল্যপ্রত্যাশী হতে হয়; বর্তমান সিইসিও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি সরকারি দলের সকল পর্যায়ের মানুষের সমর্থন পেয়ে আসছেন।

তবে এবারই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটল। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এনিয়ে কথা না বললেও সারাদেশের অধিকাংশ লোক করোনাভাইরাস আক্রান্ত বাংলাদেশে তিনটা সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণে নির্বাচন কমিশনের অদ্ভুত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। এই সমালোচনা জনস্বাস্থ্যকে সামনে রেখে, কারণ বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে জনসমাগম যেখানে চরম ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে নির্বাচনে ভোটগ্রহণের মত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসি নিয়েছে, এবং শনিবার ভোটগ্রহণও করেছে।

বর্তমান কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, নির্বাচনের প্রতি মানুষের সাম্প্রতিক অনাগ্রহ আর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্ক কিংবা সতর্কতার কারণে তিন সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে মানুষের ভোটবর্জন অনুমিতই ছিল। আদতে সেটাই ঘটেছে। ঢাকা-১০ আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ৫.২৮ শতাংশ। খোদ রাজধানীর একটি আসনে ভোটের এই চিত্র করোনা-আতঙ্কের সময়ে ইসির প্রতি মানুষের অনাস্থারই প্রতিফলন। ভাবা যায়, দেশের একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় মাত্র সোয়া পাঁচ শতাংশ ভোট পড়েছে? সাড়ে তিন লাখ ভোটারের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন মাত্র ষোল হাজার ভোটার?

ভোটের জন্যে যে সুষ্ঠু পরিবেশের দরকার, সেটা এই নির্বাচনের সময়ে ছিল না। এখানে রাজনৈতিক পরিভাষার ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ কথা বলছি না, বলছি ভোটার নির্বিশেষে সকলের জন্যে ভোটাধিকার প্রয়োগের যে পরিবেশ সেটার কথাই। ভোটগ্রহণের এই পরিবেশ ছিল না। এই পরিবেশ তৈরির ক্ষমতা ইসির ছিল না সেটা স্বীকার করি। তবে পরিবেশ নিয়ে ইসির সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এদিকে, হুট করে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে গেছে দেশ এমনটা বলার সুযোগ নাই, কারণ বর্তমান পরিবেশ বৈশ্বিক পরিবেশেরই প্রতিফলন। নভেল করোনাভাইরাসের হানায় আক্রান্ত সারাবিশ্ব। দেশে-দেশে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা। লকডাউন বিশ্বের অনেক দেশের অনেক শহর। আমাদের দেশের একটি প্রান্তিক উপজেলাকে লকডাউন করা হলেও সারাদেশে জনসমাগমের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোও বন্ধ করা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা মূলত করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে। এমন অবস্থায় ইসির এই ভোটগ্রহণ সুবিবেচনাপ্রসূত কোন সিদ্ধান্ত নয়। তবু রাষ্ট্রীয় এতসব ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে ভোটের আয়োজন জনস্বাস্থ্যকে আরও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

ভোটের হিসাবে মাত্র ষোল হাজারের সামান্য বেশি লোক ভোট দিয়েছে, এই হিসাব কাগজেকলমে থাকলেও এই ভোটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেবল ঢাকা শহরেই লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণ ছিল। এক লোকগুলোর কেউ যদি কোনোভাবে করোনা ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হয়, তবে তারা তাদের পরিবার-সমাজসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। ভোটগ্রহণ-ভোটপ্রদানে যারা ছিলেন, তাদেরকে কোনোভাবেই স্বাস্থ্য সচেতন জনগোষ্ঠীর অংশ ভাবছি না। নিজের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা সারাদেশের জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বলে তাদেরকে সচেতন ভাবার কারণ নাই। ওখানে হাইপ্রোফাইলড অনেকেই থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে তারা একটা বিষয়ে অন্তত দায়িত্বহীনতার পরিচয় রেখেছে। এই এরা সংক্রমিত হলে এবং এদের দ্বারা আরও কারও মাঝে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটলে তাদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও দায়ী করা যায়।

নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্তের এই দেশে সকল দায়িত্ব কেবল দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে কীভাবে? যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার সরকারি নির্দেশনা দেওয়ার পর খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখানে গাদাগাদি করে লোকজন নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন। মন্ত্রীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে কমপক্ষে ৩৭ জন লোক। রাষ্ট্র একদিকে সকলধরনের জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলে আবার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন জনসমাগম বাড়ে এমন রাষ্ট্রীয় আয়োজন নির্বাচনের ব্যবস্থা করে- এই ঘটনাগুলো আর যাই হোক আমাদের সচেতনতার স্বাক্ষর বহন করে না। ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ভোটের হার সিঙ্গেল ডিজিটের হলেও একই দিনে অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচনের চিত্র তেমন ছিল না। সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ভোটের চিত্রের প্রতিফলন হয়েছে। এই মানুষগুলো তাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্যে সন্দেহভাজন হুমকি হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।

নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সারাবিশ্বের মত আমরাও মহামারির মুখে। এমনিতেই এই রোগ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সময়ে আমরা আড়াই থেকে তিনমাস সময় পেলেও এনিয়ে সন্তোষজনক প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা মূলত নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনাজনিত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সময়ে একদিকে জনসমাগম এড়াতে সরকারি নির্দেশনা আর অন্যদিকে জনসমাগম বাড়াতে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে প্রমাণ করে আমরা আদতে বৈশ্বিক এই মহামারির প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে অক্ষম। অন্য অনেক কারণের সঙ্গে নির্বাচনের আয়োজনের এই খেসারত আমাদের কীভাবে দিতে হয় সে সময়ই বলে দেবে।

ঢাকার একটিসহ তিন সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করেছে। এই বোধোদয়কে সাধুবাদ জানাই। তবে ২১ মার্চ উপনির্বাচনের আয়োজন করে ইসি যে অদূরদর্শিতার প্রকাশ ঘটিয়েছে সেটা ইতিহাস মনে রাখবে। ইসি বলতে পারে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় এই উপনির্বাচন, তবে তাদের থেকে সংবিধানের দোহাই দেওয়া জনিত এই অজুহাত টেকে না যখন অন্য আসনগুলোর উপনির্বাচন স্থগিত রাখা হয়।

নির্বাচন কমিশন আগুন নিয়ে যে খেলা খেলেছে সেই খেলার আপাত সমাপ্তি ঘটেছে ঠিক, তবে এই আগুনের আঁচ কতজনের গায়ে লেগেছে সেটা কেউ জানি না। প্রার্থনা করি, সংখ্যায় তা শূন্য হোক।

এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ইসিকরোনা ভাইরাসনির্বাচন