আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে এবং বিপক্ষে

আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে এবং বিপক্ষে। হ্যাঁ একই সাথে একই শব্দের পক্ষে থাকাও যায় এবং বিপক্ষেও থাকা যায়। যেমন, আমি আগুন জ্বালানোর পক্ষে। আমার বিশ্বাস, আপনারা সবাই আগুন জ্বালানোর পক্ষেই। আগুন না জ্বালালে যে কারো পেটে খাবার যাবে না।

আবার আমি আগুন জ্বালানোর বিপক্ষে। যখন কোনো যুবক আগুনটা জ্বালায় নেশা গ্রহণের জন্য। কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করার জন্য যে আগুন জ্বালানো হয়। হাত-পা বেঁধে নুসরাতদের গায়ে যে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

তার মানে দাঁড়ালো আমি আগুন জ্বালানোর পক্ষে এবং আগুন জ্বালানোর বিপক্ষে। নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ার সমর্থন করেছি মানেই এই না আমি সমগ্র ক্রসফায়ার সমর্থন করেছি। যেমন আগুন জ্বালানো সমর্থন বলতে সমগ্র আগুন জ্বালানোকে সমর্থন বোঝায় না।

আমি কেন ক্রসফায়ার সমর্থন করি বা কোন ক্রসফায়ার সমর্থন করি, তা একটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার।

এই ক্রসফায়ার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে ফিরে যেতে হবে সেই ২০০৪ সালের দিকে। তখন আমি গ্রামে থাকতাম। খুব কাছ থেকে দেখেছি নকশাল-সর্বহারাদের উত্থান। চরমপন্থিরা কত নিষ্ঠুর, কত ভয়াবহ হতে পারে; তা কাছ থেকে দেখেছি।

বাবাকে দিয়ে গর্ত করিয়ে সেই গর্তে ছেলেকে ফেলে জবাই, ভাইকে দিয়ে ভাইকে জবাই, বাবা-ছেলেকে এক সাথে খুন… এসবই ছিল নিত্যকার ঘটনা। গ্রাম্য শালিস, ছোট-খাটো যে কোনো ঘটনায় টাকা খেয়ে ভিকটিমকেই বড় ধরণের জরিমানার মুখে ফেলাসহ কত সব ব্যক্তিগত, সামাজিক অন্যায় করেছে এই নকশাল-সর্বহারারা।

এমন পরিবার ছিল না, যারা কোনো ঝামেলায় পড়ে নাই কখনো। ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করেছে। বাবা-মা পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছে। সেই পরিবারে গিয়ে সবচেয়ে ফিট, স্বাস্থ্যবান ছেলেটাকে চরমপন্থিদের দলে নাম লেখাতে বাধ্য করেছে। নাম না লেখালে মেয়েদের উপর যৌন অত্যাচার, বাবা-মায়ের উপর শারীরিক অত্যাচার ছিল কমন অস্ত্র।

একটা টিনের ঘর তুলতে গেলেও চাঁদা দিতে হতো। দোকান খোলা চাঁদা। দোকান বন্ধের চাঁদা। বিক্রি ভালো হলে চাঁদা। কেউ বিদেশ গেলে চাঁদা। চাকরি পেলে চাঁদা। পুকুর থেকে মাছ ধরলে চাঁদা। কত ধরণের চাঁদা হতে পারে তা আমরা দেখেছি।

বাধ্য হয়ে গ্রামের মানুষজন একত্র হয়ে দেশি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে গ্রাম পাহারা দিয়েছে। রাতের আঁধারে বিদেশি অস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীর উপর হামলা করেছে চরমপন্থিরা। যাকে সামনে পেয়েছে সমানে হত্যা করেছে। এসব ঘটনা আমার শৈশব জুড়ে দেখতে হয়েছে। আমরা ভয়ে থেকেছি। এই বুঝি নকশাল এলো। এই বুঝি সর্বহারা এলো।

তারপর সম্ভবত ২০০৪ সালে একদিন পত্রিকায় দেখলাম বড় করে লেখা, ‘ক্রসফায়ারে চরমপন্থি নেতা নিহত’। পরের দিন দেখলাম এমন খবর। এভাবে প্রায় প্রতিদিন ক্রসফায়ারে চরমপন্থিরা মরতে শুরু করল। প্রতিদিন ১০ জন ১২ জন কিংবা ১৫ জন করে চরমপন্থি মারা যায় ক্রসফায়ারে। আমরা ভেতরে ভেতরে উল্লাস করি। মুক্তির আনন্দ খুঁজি। কিন্তু উৎসব করতে পারি না, যদি আবার ফিরে আসে?

এভাবে মারতে মারতে একসময় চরমপন্থিরা গ্রাম ছাড়লো। গ্রামে স্বস্তি ফিলে এলো। শান্তি ফিরে এলো। আমরা ক্রসফায়ারকে ধন্যবাদ দিতে শুরু করলাম।

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তারপর আমরা দেখলাম ক্রসফায়ারকে রাজনীতির হাতিয়ার হতে। এর পরের গল্প সবার জানা। নতুন করে বলার কিছু নাই। নানান অপকর্ম হয়েছে ক্রসফায়ারের নামে। আপনাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কোনো কাজই হয় নাই। ক্রসফায়ার চলছে ক্রসফায়ারের নিজস্ব গতিতে।

নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ার সমর্থন করায় অনেকে আমাকে ধুয়ে দিচ্ছেন। ফেসবুকে ব্লক পর্যন্ত দিয়েছেন। তাদের যুক্তি আমি একটা ক্রসফায়ারকে সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সকল ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিচ্ছি। তাদের যুক্তি দেখে আমার প্রচণ্ড হাসি পায়। তাদেরকে বলি, আরে মিয়া আমার আপনার বৈধতার খবর নেওয়ার জন্য রাষ্ট্র মনে হয় কান পেতে বসে আছে? রাষ্ট্র চলছে তার নিজস্ব শক্তিশালী গতিতে। আপনি আমি সমর্থন দিলেও সে তার কাজ করবে, না দিলেও করবে। আপনার প্রতিবাদে কোন অন্যায়টা থেমেছে এখন পর্যন্ত?

স্যানেটারি প্যাডের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের উদাহরণ দিতে পারেন। এমন উদাহরণ দিলে আমার আবারও হাসি পাবে। আপনি চেয়েছেন বলে প্যাডের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার হয় নাই জনাব, রাষ্ট্র চেয়েছে বলেই হয়েছে। কই আপনি তো গ্যাসের বাড়ানো দাম কমানোর দাবি করেছিলেন, হয়েছে?

অতএব এসব আপন ভোলানো যুক্তি দিয়ে আপনাকে যত খুশি ভোলান, অন্যদের ভোলাতে আসবেন না। প্রকাশ্যে যে সন্ত্রাসী একজন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে স্বাভাবিক বিচারে তার কিচ্ছু করতে পারতো না।

দেখেন নুসরাত কবরে মাটির সাথে মিশে গেছে। তার খুনিরা রাষ্ট্রের খেয়ে-পরে আদালতে হাজিরা দিয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো এক বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ম্যাচের আগে তারা ছাড়াও পেয়ে যাবে। আমরা মেতে থাকবো ক্রিকেট নিয়ে। তার চেয়ে ভালো ক্রসফায়ারে গেছে।

এ জন্যই ভবিষ্যতে কেউ রামদা হাতে নেওয়ার আগে একবার অন্তত নয়ন বন্ডের পরিণামের কথা মাথায় আনবে। সেদিন বেঁচে যাবে কোনো রিফাত।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ক্রসফায়ারবন্দুকযুদ্ধ