আবার রক্ত ঝরলো পাহাড়ে। রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলায় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে ফলাফল ও সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে সর্বশেষ ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গুলিতে গুরুতর আহত কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাই মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা গেছে।
পাহাড়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক গ্রুপ ও সংগঠন এবং সরকারের সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই একমাত্র পাহাড়ে শান্তি আনয়ন করা সম্ভব, অন্যথায় পাহাড়ে চলমান অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করি।
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, পাহাড়ে গত ১৫ মাসে সংঘাতে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ সংযোজন হয়েছে গতকালের ঘটনাটি।
১৯৭২ সালে জেএসএস গঠিত হয়, ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পরে জেএসএসের বাইরে ইউপিডিএফ গঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে মূল জেএসএস ভেঙ্গে গঠন করা হয় জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে একটি নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের সংস্কৃতিতে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে এবং পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিষয়টি উতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা স্থানীয় নির্বাচনের তুলনায় বেশি। তার মানে এই নয় যে, স্থানীয় নির্বাচনে সহিংসতা ঘটে না। তবে রাঙামাটির আলোচিত ঘটনাটি ভিন্ন বার্তা বহন করছে, বিশেষ করে ভোট গ্রহণ শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গন্তব্যে ফেরার পথে যেহেতু হামলাটি ঘটেছে সেহেতু পূর্ণ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ঘটনার কারণ সম্বন্ধে সঠিক করে কোন কিছু বলা সম্ভব হবে না।
তবে, রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানোর পাশাপাশি পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যও যে রয়েছে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। বিশেষভাবে, নির্বাচনে কারচুপি বা ফলাফল নিজেদের মতো করে প্রকাশ করার জন্য ভোটগ্রহণ চলাকালীন কিংবা ভোটের পূর্বে হামলা করার কথা ছিল, কাজেই হামলাটি ভিন্ন বার্তা বহন করে থাকে এবং ঘটনাটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে যে অশান্তি চলে আসছে তার পিছনে একাডেমিশিয়ান গবেষকরা নানাবিধ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে মোটা দাগে বেশ কয়েকটি কারণকে আলোচনায় নিয়ে আসা যায়। বিবিসির একটি বিশ্লেষণে নিম্নোক্ত কারণগুলো উঠে আসে, এছাড়াও বেশ কয়েকটি কারণ যেমন: স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির চুলচেরা হিসাব নিকাশ, স্থানীয় সংগঠনগুলোর মধ্যকার আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা পাহাড়কে প্রায়শই অশান্ত করে তোলে। সেখানকার সংগঠনগুলো মনে করে, সংঘাত বন্ধের চাবি সরকারের হাতে। আবার প্রশাসন মনে করে, আঞ্চলিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মতানৈক্যে পৌঁছালে সহসাই পাহাড়ে সংঘাত বন্ধ করা সম্ভব হবে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন। শান্তি চুক্তির ২০ বছর হয়ে গেলেও এখনো চুক্তিটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদেরকে নানাভাবে উত্তেজিত ও অবজ্ঞা করে রাখে। তবে সরকার বলছে চুক্তির বাস্তবায়ন চলছে এবং আস্তে আস্তে সব কটি চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু ২০ বছর সময় অনেকের কাছে কম মনে হলেও পাহাড়িদের কাছে এটি বিরাট সময়ের প্রতীক্ষা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতীক্ষার বাস্তবায়ন না ঘটায় পাহাড়িদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়। ফলশ্রুতিতে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস/অবিশ্বাস, স্থানীয়ভাবে প্রভাব রাখার ব্যর্থতা সহ নানাবিধ কারণে পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলো সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
যথাসময়ে আঞ্চলিক ও পার্বত্য পরিষদের নির্বাচন না হয়ে নেতা নির্বাচন না করাও পাহাড়িদের মনে বিক্ষোভের সৃষ্টি করে থাকে। নিয়মিত ভিত্তিতে পাহাড়ে নির্বাচন করার কথা, কিন্তু শান্তি চুক্তির সময়ে মনোনীত নেতারা এখনো পাহাড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কাজেই নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়া এবং যারা দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছে তাদের বলয়ের নেতারা নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার পায়তারা করে থাকে এবং অন্যদের নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চিত করে থাকে।
ফলশ্রুতিতে উদীয়মান এবং প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না এবং একটি গ্রুপ বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নতুন এবং মেধাবী নেতৃত্বের অভাবে পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হিংসা প্রতিহিংসার খেলা চলছে এবং উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য জেলাগুলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা এখনো প্রকট। ব্রিটিশ আইন ও প্রচলিত নিয়ম মোতাবেক পাহাড়িরা জন্মগতভাবে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে সে ভূমির মালিক তারাই। কিন্তু পাহাড়ে বাঙালিদের বসতি স্থাপনের কারণে ভূমি সমস্যা মারত্নক আকার ধারণ করেছে। তাছাড়া ভূমি সমস্যার জন্য সরকারের গঠিত কমিশন ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ তেমনটা নিষ্পত্তি করতে পারেনি বিধায় সমস্যাটি এখনো জাজ্বল্যমান।
কাজেই ভূমি সমস্যার স্থায়ী এবং সুষ্ঠু সমাধান না হওয়ার ধরুন পাহাড়ে সংঘাত এবং সহিংসতার রাজনীতি বিদ্যমান রয়েছে।
পার্বত্য চুক্তির সময় পাহাড়িদের নিজেদের মধ্যে ততটা বিরোধ ছিল না। কিন্তু কালক্রমে এবং সময়ের আবর্তে পাহাড়িরা নিজেদের মধ্যে নানাবিধ বিরোধ ও সংকটে জড়িয়ে পড়ছে। পিসিজেজেএস সংগঠনটির সামগ্রিক কার্যক্রম শান্তিচুক্তির সময় উজ্জ্বলতা বহন করে এবং সে সময় এই সংগঠনটির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পাহাড়ে। পরবর্তীতে শান্তি চুক্তির সাথে দাবি দাওয়ার সামঞ্জস্যতা ও ত্রুটি বিচ্যুতি থাকায় তরুণ ছেলেমেয়েরা ইউপিডিএফ গঠন করে।
যার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি সংগঠনই নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। (পিসিজেজেএস) পিসিজেজেএস-এম এন লারমা এবং (ইউপিডিএফ) ইউপিডিএফ-ডেমোক্রেসি নামে সংগঠন দুটি ভাগ হয়ে যায় এবং তার পর থেকেই পাহাড়ে আতংক এবং ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড়ি এবং বাঙালিদের অবস্থান সমানে সমান। পাহাড়ে ৫ লাখ বাঙালি থাকার কথা ছিল এবং শুরুতেই সেখানেই ৪ থেকে ৫ লাখ বাঙালি স্থানান্তর করা হয়। পর্যায়ক্রমে পাহাড়ে বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অবস্থানকে পাহাড়িরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি এবং এখনো দেখা যায় দুপক্ষ ছোটখাটো কারণে নিজেদের মধ্যে প্রবল আক্রোশের সৃষ্টি করে থাকে এবং যার প্রতিক্রিয়া দেশের অন্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই বাঙালিদের বসতি ও পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করতে না পারলে পাহাড়ে অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে না।
সারা বাংলাদেশে উন্নয়নের যে চিত্র পরিলক্ষিত হয় এবং অন্যান্য স্থানের জনগণ যে ধরনের সুযোগ সুবিধার অভ্যস্ততার মধ্যে বেড়ে উঠছে তার তুলনায় পাহাড়ে সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জেলার সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপ্রতুল, নিমিষেই কোথাও যোগাযোগ করা যায় না।
কাজেই, পাহাড়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতের যে সচিত্র অবস্থা বিরাজমান তা দূর করতে হবে সকল পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই। আঞ্চলিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সমন্বিত মধ্যস্থতায় পাহাড়ে শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন করতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। আমরা পাহাড়ে কোনরূপ অশান্তি দেখতে চাই না, শান্তির বাতায়ন নিয়ে বসবাস করুক পাহাড়ি-বাঙালি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।