‘অবৈধ সংসদের’ কাছে বৈধ প্লট দাবি?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে মঙ্গলবার একটি খবর বিভিন্ন মহলে মুখরোচক আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। খবরটি হলো- সংরক্ষিত নারী আসনের বিএনপিদলীয় সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা রাজধানী উন্নয়নক কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠার একটি প্লটের জন্য আবেদন করেছেন। জাতীয় সংসদের প্যাডে গত ৩ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী বরাবর এই আবেদন করেন তিনি।

প্লটের জন্য আবেদন করে রুমিন ফারহানা আইন কিংবা শপথ ভঙ্গ করেছেন- এমন কথা আমি বলছি না। তবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, নিজের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ইতোপূর্বে নেওয়া নীতিবোধের শক্ত অবস্থান থেকে তিনি পিছু হটেছেন। সোজা-সাপটা বাংলায়, তিনি লোভ সংবরণ করতে পারছেন না।

আমাদের দেশের মন্ত্রী ও সাংসদদের সরকারি প্লট বরাদ্দ ও শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের রেওয়াজ আছে। এমনকি বর্তমানে সাংসদ না হয়েও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকদিন আগে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

শুধু মন্ত্রী-সাংসদরা নন, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা ও জনপ্রতিনিধি না হয়েও বহু রাজনীতিবিদ অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তবে এই সুযোগটা সব সরকারের সময়েই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বেশি পেয়ে থাকেন। এছাড়া বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ী স্থান পাওয়ায় ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সুবর্ণ সুযোগ উপভোগ করছেন। 

নির্বাচনের আগে জনগণের ভাগ্য বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর নিজেদের ভাগ্য বদলের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠেন তারা। আর জনগণকে দেখেন প্রজার চোখে। এমন আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি শুধু জনপ্রতিনিধিদেরই নয়, অনেক সরকারি কর্মকর্তাও সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকেন। তাদের তালিকায় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, “অনেক ডিসি-এসপি আছেন, যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন।” তবে এ কথা ঠিক যে, সকল জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ ও ব্যবসায়ী অসৎ নন; ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়ের এই যুগে এখনও বহু সৎ, নির্লোভী ও নির্ভীক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলা আছেন।

রুমিন ফারহানা এক সময়ের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক প্রয়াত অলি আহাদের মেয়ে। বিলেত থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে নামের আগে ব্যারিস্টার লেখার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। বিএনপিসহ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদরাও শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তবে নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তেই তারা শপথ নেন।

জাতীয় সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক হারে বিএনপির ভাগে পড়ে মাত্র একটি। শুরু হয় দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌঁড়ঝাপ। শেষ পর্যন্ত রাজটিকা জেগে ওঠে রুমিন ফারহানার ললাটে। এক যুগ ধরে লন্ডনে সপরিবারে বসবাসরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের (আইনের দৃষ্টিতে পলাতক ও আদালতের রায়ে দণ্ডিত) বিশেষ আশীর্বাদে সুদর্শনা এই ব্যারিস্টার পেয়ে যান মনোনয়ন। যদিও দলের মধ্যে দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া, ত্যাগী ও ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতি করা অনেক নারীনেত্রী আছেন; যাদের অবদান এই তরুণী আইনজীবীর চেয়ে অনেক বেশি। মনোনয়নপ্রাপ্তির পর যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণ ও সংসদ অধিবেশনে যোগদান করেন তিনি। এসবের কোনকিছুতেই আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

তবে রুমিন ফারহানা প্রথম দিন অধিবেশনে যোগ দিয়েই বিতর্কের জন্ম দেন এবং সংসদ উত্তপ্ত করে তোলেন। আলোচনার শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদকে সরাসরি অবৈধ বলে উল্লেখ করেন তিনি। অথচ তাকে কেউ জোর করে সাংসদ নির্বাচিত করেনি, পেশিশক্তির প্রভাব দেখিয়ে শপথ নেওয়ায়নি এবং জবরদস্তি করে সংসদে পাঠায়নি। নিজের রাজনৈতিক অভিলাস চরিতার্থ করতে লন্ডনী আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বিএনপির মতো একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের একমাত্র নারী সাংসদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

রুমিন ফারহানা ১০ কাঠার প্লট পাওয়ার জন্য যে মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন, তিনি এই সংসদেরই একজন নির্বাচিত সাংসদ এবং এই একাদশ সংসদ গঠিত হওয়ার পরই বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। এছাড়া তিনি যে প্যাডে আবেদন করেছেন, সে প্যাডটিও জাতীয় সংসদের মনোগ্রাম সংবলিত এবং আবেদনের নিচে পরিচয় হিসেবে লেখা রয়েছে- “রুমিন ফারহানা, সংসদ সদস্য, একাদশ জাতীয় সংসদ, ৩৫০-মহিলা আসন-৫০।” বাহ্! চমৎকার। 

হ্যাঁ, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে, রয়েছে নানা বিতর্কও। তাই বলে সংসদ তো অবৈধ নয়। ভোটগ্রহণ নিয়ে যতো প্রশ্নই থাকুক, দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সুতরাং একাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল অংশগ্রহণমূলক। অথচ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে তো বিএনপি ও তাদের ভাড়া করা কতিপয় প্যাডসর্বস্ব দল ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দলই অংশ নেয়নি। তা সত্ত্বেও মাত্র ১৩ দিন বয়সী ওই সংসদেই ঐতিহাসিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল এবং সকল রাজনৈতিক দল তা মেনে নিয়েছিল।

এ ইতিহাস নিশ্চয়ই রুমিন ফারহানার অজানা নয়। এছাড়া তখন তার বাবা প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ অলি আহাদও জীবিত ছিলেন। তাহলে একজন আইনজীবী হয়ে তিনি কীভাবে বর্তমান সংসদকে অবৈধ দাবি করেন; যে সংসদের তিনি নিজেও একজন সদস্য। আর সেই অবৈধ সংসদের কাছেই ১০ কাঠার প্লট চেয়ে আবেদন করলেন! একাদশ সংসদের বয়স প্রায় আট মাস। আর সাংসদ হিসেবে রুমিন ফারহানা মাত্র চার মাস পার করছেন। এর মধ্যেই আনুমানিক ১০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ চেয়ে বসলেন! না জানি, বাকি চার বছর চার মাসে আরো কতো চাইবেন এই অবৈধ সংসদের (!) কাছে। এ যেন ‘পতিতার কাছে বৈধ সন্তান’ চাওয়া!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

বিএনপিরুমিন ফারহানা