দেশে এখন উন্নয়নের যে চক্র চলছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অপ্রদর্শিত আয় কোনো কোনো বিশেষ সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতে সংরক্ষিত হচ্ছে। এতে ক্রমবর্ধমান হারে ঋণখেলাপি সংখ্যা ও পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, অন্যদিকে ঘুষ-দুর্নীতির সীমাহীন নৈরাজ্য দেশে লাস ভেগাসের মতো কিন্তু অবৈধ পন্থায় ক্যাসিনো ব্যবসা গড়ে উঠছে। ক্যাসিনো ব্যবসার কবলে পড়ে ফুটবল-ক্রিকেট-হকিসহ নানা সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখে। অথচ জুয়া বা আরো গভীরভাবে আধুনিকায়ন করা ক্যাসিনো ব্যবসার সাংবিধানিক, সামাজিক, ধর্মীয় কারণে বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আজ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির কাঙ্খিত হার ৮% হলেও কর্মপ্রত্যাশী কর্মক্ষম যুবক-যুবতীর একটি বড় অংশ র্কমসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। যারা ক্যাসিনোতে অংশ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ পেশাদার জুয়াড়ি হতে পারে; কিন্তু বাদবাকিরা কষ্টার্জিত আয় না করে সহজলভ্য পন্থায় অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যে বিপুল অর্থ-বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তা খরচ করতে না পেরে ক্যাসিনোতে খাটিয়েছেন।
এই ক্যাসিনো কেবল দেশে নয় বরং বিদেশেও গিয়ে নিয়মিত খেলেছেন। সরকারের শুদ্ধি অভিযানের পর যে ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসছে তাতে জনগণ বিস্মিত ও হতবাক। অথচ এরই মধ্যে একজন সচিব বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ক্যাসিনোর বৈধতা দিতে বলেছেন যা তাৎক্ষণিকভাবে অর্থমন্ত্রী নাকচ করে দেন। উক্ত সচিবের ব্যাপারে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত করে দেখা দরকার। ক্যাসিনোর সঙ্গে ওনার সংশ্রব ছিল কি না। এ শুদ্ধি অভিযানের আগে বেশ কয়েকবার সরকারপ্রধান দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন আমলা, জেলা প্রশাসক, দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন মহলের বৈঠকে বারংবার দুর্নীতি সম্পর্কে সাবধান করেছেন। বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড, বইকাণ্ডসহ নানাবিধ উপায়ে যে ধরনের দুর্নীতি চলেছে তা আসলে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
দুর্নীতি করে অপ্রদর্শিত আয়ের বদৌলতে নানা ক্ষমতার অপব্যবহার দেখা যায়। ভূগর্ভস্থ অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে জিয়া-এরশাদ আমল থেকে বেড়েই চলেছে। দেশে ক্যাসিনো অর্থনীতি চালু হয়েছিল আশির দশকে বলে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে। কিন্তু দিনে দিনে এটি এমন বেড়েছে যে, যে দলে জাতির পিতা খেলেছেন অর্থাৎ মোহামডান ক্লাব সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, অশিক্ষিত পিয়ন কেবল দপ্তর সম্পাদক হননি বরং মাসে ৩ কোটি টাকা আয় করেছেন। যদিও তর্কের খাতিরে ধরে নিই, তার আয় সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা হয়েছে; তবে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পেলেও তিনি যে বিশাল খনির মালিক হয়েছিলেন। এ তো প্রকাশ্য দিবালোকের মতো একজন কিশোর-কিশোরীও বুঝবে। অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ পথে আনা গেলে দেশে কৃষি-শিল্প খাতের মাধ্যমে বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু মিল্টন ফ্রিডম্যানের তত্ত্বের মতোই ট্রানজিটরি ইনকাম এর মতো এটি ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় ট্রানজিটরি কনজামশন-এ ব্যয়িত হয়েছে। যেখানে একটি অর্থনীতির জন্য অপ্রদর্শিত আয় ৫ থেকে ৭ শতাংশ হতে পারে সেখানে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এটির হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
গরীব উন্নয়নের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে আর নব্য ধনীদের উত্থান এত দ্রুত গতিতে হচ্ছে যে ধনবৈষম্য-আয়বৈষম্যে বৈশ্বিক প্রভাব থাকলেও এদেশে তা আরো প্রকট হচ্ছে। যেখানে একজন ডাক্তারি পাশ করে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পান না, সেখানে আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্বল্পতা হেতু আয়ের পরিমাণ মাসিক ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা। অথচ তাদের কাছ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কিন্তু আয়কর যথাযথভাবে আদায় করতে অক্ষম। এদের খুঁটি অনেক শক্ত। এদের অপ্রদর্শিত আয়ের একটি অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে, আরেকটি অংশ এমনভাবে ব্যয়িত হচ্ছে, যা মোট জাতীয় উৎপাদনে কাজে লাগছে না বরং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সংকুচিত করছে।
আসলে সমাজে ধনবৈষম্য বাড়ছে অন্যদিকে সরকারের আন্তরিক প্রয়াসে অবশ্য গ্রামীণ এলাকার বিভিন্ন ধরনের আয়বর্ধক প্রোগ্রামের আওতায় কিছু মানুষের জীবনমান বেড়েছে। এদিকে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক পত্রিকান্তরে মন্তব্য করেছেন যে বাংলাদেশে লাস ভেগাসের মতো শহর তৈরি করলে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব, তবে গবেষণার প্রয়োজন নেই। আসলে ঐ সচিবের মতোই ছাত্রীটি স্যারকে উন্নত হওয়ার কথা বলতে চাইছিল। এ ধরনের সচিব এবং যারা ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্ট তাদের নীতিজ্ঞানহীনতা এবং সব হাব ভাব সমাজের জন্য একধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। নানাভাবে শিক্ষিত মানুষেরা দুর্নীতির বিশাল চক্করে পড়ে যাচ্ছে। যাকে যেখানে পদায়ন করা হচ্ছে, হয় সে নিজে খাচ্ছে নতুবা আপস করে অন্যকে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
আসলে ক্ষমতাবানরা এত প্রতাপশালী হয়ে উঠছে যে তারা বৈধ-অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ বিদেশে প্রেরণ করছে। সরকারপ্রধানের নির্দেশ অমান্য করে মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পারস্পরিক সহযোগিতায় ঋণখেলাপিরা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এ বিদ্যমানতা নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে বাধার সঞ্চার করছে। ব্যাংকারদের এখন সাধারণ মানুষ নিচু চোখে দেখছে, যদিও সিংহভাগ দায়ভার হচ্ছে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের। যদি মন্ত্রণালয় সরকারপ্রধানের নির্দেশ অমান্য করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সেটি জনমনে কোটি টাকার প্রশ্ন! এদিকে এ গ্রুপটি তলে তলে বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াপাড়া, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, মাদক ব্যবসাসহ সিংহভাগ নিজেদের অপকর্ম মুনাফেকের মতো দলের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।
এক্ষেত্রে একটি অভিমত, মনমোহন সিং সরকার থাকাকালে ভারতে কেউ দুর্নীতি করলে যত বড়ো ক্ষমতাধরই হোক না কেন, জেলে যেতে হতো এখানেও তা-ই করা দরকার। এখন আবার সমাজে দুটো ভীতি কাজ করছে আমলাভীতি ও পুলিশভীতি। কিন্তু একটু গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম যে, চিকিৎসকদের সেবা না পাওয়ার ভীতি আরো গভীর, যে কারণে জমি বেচে অনেকে বিদেশে চিকিৎসা করতে যাচ্ছে। এর ফলে দেশ থেকে অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রকৌশলীদের একাংশের দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের কথা, ব্যাংকারদের অবৈধ আয়ের কথা আগেই জানা ছিল। এখন যুক্ত হয়েছে শিক্ষকদের একাংশের দুর্নীতি। আসলে অপ্রদর্শিত আয় সমাজব্যবস্থার কেবল ক্ষতি করছে, তা-ই নয় বরং সমাজে আছে এবং নেই এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করছে। প্রান্তিকীকরণ করছে এমনকি প্রপারাইজেশন তৈরি করছে। ভাগ্যিস, সরকার সোশ্যাল সেফটি নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। কিন্তু বেকারদের জন্য তেমন কিছু নেই, বেকার ভাতা চালু করা বিশেষ দরকার।
যদিও উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তার বিতরণ ও আদায়ের কোনো পরিকল্পনা না থাকায় আগ্রহী তরুণ-তরুণীরা উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হলেও ঋণ পাচ্ছে না, বরং কায়েমি স্বার্থবাদীরা সে সমস্ত ধনসম্পদ লুট করে নিচ্ছে। যদিও কোনো ব্যাংক বারডেমের মতো প্রতিষ্ঠানে ১ কোটি টাকা সিএসআর-এর আওতায় দিয়ে মহৎ কাজ করার পরও দোষী হয় অথচ অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করার পর ধরা পড়লে ১৬ ফিট মাটির নিচে হাসপাতাল করে বেঁচে যান। তাহলে এটি একটি জুয়া। ড. এ কে এনামুল হক যথার্থই বলেছেন, ক্যাসিনো তত্ত্বটি নতুন। এ তত্ত্বটির সরব উপস্থিতি বন্ধ কররেত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)