অপু বিশ্বাস: বাঙালি নারী সমাজের প্রতিচ্ছবি

নারীর উন্নয়ন, নারী মুক্তি এবং নারীদের স্বাবলম্বীকরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও গবেষকদের তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারীদের স্বাবলম্বীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ ও এর ফলে নারীদের পরিবর্তনের সার্বিক চিত্র খুবই ইতিবাচক। বই পুস্তকের হিসাবের সাথে বাস্তবের অনেক চিত্রই ব্যতিক্রম তথ্য উপাত্ত প্রদান করে থাকে।

তবে ব্যতিক্রম কিন্তু উদাহরণ হতে পারে না, আবার কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। সেসব ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণকে সামনে আনলে গবেষণাধর্মী ফলাফল কিংবা তথ্য উপাত্ত ভুল প্রমাণিত হয়। অবশ্য ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই। দেশে নারীর সুসংহত অবস্থান দিন দিন ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, বিভিন্ন সেক্টরে বহু জায়গায় নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় মেয়েরা পূর্বের তুলনায় অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং কিছু কিছু জায়গায় পুরুষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে নারীরা। তবে কিছু কিছু ঘটনা নারীদের পশ্চাৎপদতাকেও হার মানায়, যেখানে নারীদের মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায়ন্তর থাকে না। তেমনি একটি ঘটনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরাই প্রদত্ত নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে বিভিন্ন ফোরামে গঠিত কমিটি নিয়ে ব্যাপক সরগরম দেখা যায়। কারণ গঠিত কমিটিগুলো নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। আর সেই সরগরমে রসদ যুগিয়েছে শাকিব অপুর সাংসারিক জীবনের কেচ্ছাকাহিনী। দু’জন দু’জনকে ভালবেসে বিয়ে করেছে, আড়ালে আবডালে সংসারও পেতেছে। সবকিছু ঠিকই ছিলো বিপত্তি ঘটে তখনই যখন অপু বিশ্বাস প্রকাশ্যে ছেলে সন্তান নিয়ে টিভিতে হাজির হন এবং বিয়ের কথা সকলের সামনে তুলে ধরেন। তখনই বেঁকে বসেন হালের নিজের সুনাম নিজেই করে বেড়ানো, এক সময়ের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কালো অধ্যায়ের অন্যতম ব্যস্ত নায়ক শাকিব খান।

যে সকল নায়িকারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অন্ধকার সময়ে অভিনয় করে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সাথে নায়ক শাকিবের একাধিক ছবি রয়েছে। সেসময় যদি শাকিবকে নিষিদ্ধ করা হতো তাহলে বিচারটি সমমনা হতো। মেয়ে চরিত্রকে যেখানে নিষিদ্ধ করা হয়, তার সাথের পুরুষ চরিত্রটিকেও নিষিদ্ধ করা উচিত নয় কি? বিষয়টা গ্রাম্য সালিশের মতোই হয়েছে- রায় যাই হোক না কেন ছেলে দোষী হলেও মেয়েকেই অপরাধের বোঝা বয়ে নিতে হয়। শাকিব খানের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে-চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নিয়েছে মুনমুন, ময়ূরীরা আর সেখানে এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন কালো যুগের প্রতিষ্ঠিত নায়ক শাকিব খান।

ছেলে অাব্রাহাম খান জয়ের সঙ্গে শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস

অপু বিশ্বাস বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি জনপ্রিয় নাম। নিজের যোগ্যতা এবং মেধার বরাতে চলচ্চিত্রে নিজের আসন স্থাপন করেছেন। তার অসংখ্য চলচ্চিত্র সিনেমা প্রেমিদের মনে ঠাঁই করে নিতে সমর্থ হয়েছে। স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই অপু বিশ্বাস কয়েকদিন পূর্বে বলেছেন; তিনি আর অভিনয় করবেন না। ধর্ম কর্ম এবং সংসারজীবনে মনোযোগী হবেন। এ বিষয়টির কার্যকারণে নানামুখী চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে এক ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে তাত্ত্বিক কর্মোদ্যান বের হয়ে আসে। একটা মেয়ের জীবনে তার বিয়ে অমূল্য সম্পদ এবং এটা সে স্বাভাবিকভাবেই চায় সবার মাঝে প্রকাশ করতে। এ ক্ষেত্রে অপু তার স্বামীর চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে বিয়ের ৮ বছর পরে প্রকাশ করেন স্বামীর অপলীলা দেখার পরেই। বাঙালি মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে কিন্তু স্বামীর অধিকার কাউকে দিতে পারে না। অপুও তার ব্যতিক্রম নয় কোন কারণেই। কেউ যদি আমাকে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে ‘ফ্যামিলি টাইম’ নামে পোস্ট করে কোনভাবেই আমার বিবাহিত স্ত্রী সহ্য করতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক, অপুও সেই বিবেচনায় বিয়ে এবং সন্তানের বিষয়টি সবার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন এবং তাতে দোষের কিছু না দেখি না আমরা।

অপু বিশ্বাস শাকিব খানকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। ভালবাসার কোন সীমারেখা থাকতে পারে না, থাকেও না কারণ ভালবাসা অন্তর থেকে নিঃসৃত হয় এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অপু সেটিও প্রমাণ করেছিলেন। সামজিক বাস্তবতায় একজন মানুষের পক্ষে বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া কতটা কঠিন কাজ তা সহজেই অনুমেয়। অপু বিশ্বাস সেই কঠিন কাজটিই ভালবেসে করেছেন। কিন্তু শাকিব খান তার বদৌলতে কী পুরস্কার দিয়েছেন; বিয়ের কথা প্রকাশ করা যাবে না, চলচ্চিত্র থেকে অপুকে সরে যেতে হবে, অথচ নিজে অন্যদের সাথে গোপনে আবডালে মেলামেশা করবেন, অন্যদের পারিবারিক আড্ডায় নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন অথচ সেখানে অপুকে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। বিয়ের কথা ফাঁস করার পর থেকেই অপু বিশ্বাসের সাথে শাকিব খানের মুখ দেখাদেখি হয় না; এমনকি ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত হননি শাকিব খান। আবার ছেলেকে রেখে অপু বিশ্বাস যখন চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যায়, তখন শাকিব খান অপুর নামে নালিশ করতে পুলিশের দ্বারস্থ হয়। এ কেমন দায়িত্ব পালন শাকিব খানের, যদিও পুলিশের কাছে পাত্তা পায়নি শাকিব খান। ফলশ্রুতিতে শাকিব খান অপুর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে সম্পর্কের পরিণতি তথা নিষ্পত্তি সোজা বাংলায় ডিভোর্সের দিকে ইঙ্গিত করেন।

উপায়ন্তর না দেখে অপু বিশ্বাস কলকাতা থেকে ফেরত এসে সব ছেড়ে সংসার ধর্মের দিকে মনোযোগী হবেন বলে সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অনৈতিক ইচ্ছা এবং অন্যায্য দাবিকে কেন অপু বিশ্বাসকে মেনে নিতে হচ্ছে? আজকের অপু বিশ্বাস অনেক সংগ্রাম ও সাধনার ফসল তবুও কেন নিজের ইচ্ছেকে তথা প্রাণের পেশাকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে? এ রকম মনস্তাত্বিক নির্যাতনের ভয়াবহতা শারীরিক নির্যাতন থেকে অনেক বেশি সুতীব্র হয়। অপু বিশ্বাস অনেকের চোখেই তাদের স্বপ্নের তারকা এবং আদর্শ, কাজেই এত এত ভক্তের প্রিয় তারকার অবনমন তাদেরকে আহত করবে, মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেই সকলেই। সুতরাং মানসিক নির্যাতনের স্বরূপ উন্মোচন এবং এর ভয়াবহতা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। অপু বিশ্বাসের এহেন পরিণতি এবং সামাজিক বাস্তবতার কারণে বোঝা যায়, বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এখনো কতটা ভয়ানক আকারে নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে থাকে।

শাকিব ও বুবলী

পাশাপাশি শাকিব খান সমাজের অনেকের কাছ থেকেই হয়তবা ইঙ্গিত নিচ্ছেন বা অপুকে মানসিকভাবে শায়েস্তাকরণের জন্য মিডিয়ার ন্যায় অনেক তারকার কাছ থেকে সাপোর্ট নিচ্ছেন। এমনও হতে পারে অপুর জনপ্রিয়তায় পরশ্রীকাতর হয়ে উঠতি অনেক নায়িকাই শাকিবকে প্ররোচণা দিচ্ছেন। আর শাকিব খানও নিজের পরিবারের কথা তথা তার সন্তানের কথা না ভেবে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন অন্যায় এবং বিবেকহীনতার প্রলয়োল্লাসে। আর সেক্ষেত্রে অপু অনেকটা একা, শাকিব খান যখন অপুর বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবাদ করে ঠিক সেসময় অপুর পক্ষ হয়ে সহসাই কেউ কথা বলতে আসে না। এই যে হীনমন্যতা ও নারীর পক্ষ হয়ে কথা বলার সৎ সাহসের অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো নারীর প্রাপ্ত বিচারের পথে বাধাস্বরূপ।

একবার ভাবা যায়, একজন মানুষকে তার উন্মুক্ত জগত থেকে সকল ধরনের সম্পর্ক ছেদ করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আবদ্ধ করে রাখা হলে মানুষটা তার সহজাত জীবনাচরণ থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে অস্বাভাবিকতা মেনে নেয় এবং যার পরিণতি হয় খুবই ভয়ানক। ক্রিমিনোলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশেও চর্চা ও গবেষণা শুরু হয়েছে বিবর্তনের সূত্র ধরেই। তাই নারী ভিক্টিম ও তাদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

অপু বিশ্বাস সবকিছু মেনে নিয়েই অভিনয় থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন। এত কিছুর পরেও কি অপু বিশ্বাসের শেষ রক্ষা হলো? গতকাল সবকটি পত্রিকায় অপুকে ডিভোর্সের নোটিশ সংক্রান্ত নিউজ ছাপা হয়েছে। অপু অনেকটা বাকরুদ্ধ, আবার শাকিবের বাবাও ডিভোর্স সংক্রান্তে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। শাকিব খান কয়েকজন সাংবাদিককে ডিভোর্সের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আমার প্রশ্ন হয় এ কেমন সন্তান? এত বড় একটা বিষয় অথচ নিজের বাবার সাথে কোন রকমের আলাপ আলোচনা ছাড়াই বউকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। পাঠকের শাকিব খান সম্পর্কে বুঝতে আর বাকি নেই। দুঃখ হচ্ছে অপু বিশ্বাসের জন্য, দুঃখ হচ্ছে তাদের সন্তান আব্রামের জন্য। এ সন্তানটি যখন বড় হয়ে বুঝতে শিখবে তার বাবা তার মাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্যের সাথে সংসার করছে (ইতিমধ্যে কয়েকটি সংবাদে শাকিবের বিয়ে নিয়ে নিউজ বেরিয়েছে, যদিও নিউজগুলো অনুমাননির্ভর), তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি ধিক্কার চলে আসবে নিমিষেই।

অপু বিশ্বাস

অপুর জন্য শুভকামনা, আপনার সামনের চলার পথ মসৃণ হোক। আপনি নতুন উদ্যমে আপনার সন্তানকে নিয়ে জীবনযাত্রা শুরু করবেন এমনটাই প্রত্যাশা। যে স্বামী আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করে, তার সাথে সংসার করে জীবনে আর যাই হোক কখনো সুখী হতে পারতেন না। বিয়ের কথা প্রকাশ হওয়ার পর একদিনও কি আপনার সাথে সংসার করেছে আপনার স্বামী? আপনি নির্যাতিত বাঙালি নারীর প্রতীক হয়ে অনন্য সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন। একবার চিন্তা করুন কী একটা নিছক বিষয়কে উদ্ধৃতি দিয়ে আপনাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। আমার তো মনে হয়, আপনার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, কেন সে আপনাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে না। সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় শাকিব খান দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। যাই হোক, আপনি নতুনভাবে শুরু করুন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অবিরাম সংগ্রাম করে যান।

এ রকম ঘৃণিত দায়িত্বহীনতার পরেও আমাদের সমাজ শাকিবকেই গুরুত্ব দেয়, শাকিবের সিনেমার পূজা করে। আর অপুর মতো নির্যাতিতদের কটু কথা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়। কবে ঘুম ভাঙবে আমাদের সমাজের?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

অপু বিশ্বাসশবনম বুবলিশাকিব খান