নিজ দলের কতিপয় যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের হামলায় নির্মমভাবে আহত ও অপমানিত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহমেদ মৃধা শৈলকূপার কৃপালপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। হাতে-পায়ে তার এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, শরীর জুড়ে ব্যথাও রয়েছে। চলতে ফিরতে হাঁটতে কষ্ট হয়। দু পায়ে, পিঠে-কোমরে তার শত আঘাতের চিহ্ন। তবে এর বাইরে তার পুরো অবয়বে রয়েছে অপমান ও পরাজয়ের বেদনার তীব্র ছাপ। অপমান ও পরাজয়ের রক্তক্ষরণে মৃক্তার হোসেন মৃধা যেনো এক মৃত মানুষে পরিণত হয়েছেন। সেই অপমান যেনো আরও ধেয়ে আসছে-কারণ হামলাকারীরা বলছে তাদের কিছুই হবে না। উল্টো মৃক্তার মৃধাকেই শৈলকূপার মাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার মৃধা আজীবন মুজিব আদর্শের প্রতি ভীষণরকম অটল থাকা সৎ, নির্লোভ এক নেতা। ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সদস্য তিনি। তবে এর চেয়েও বড় কথা যেদিন ঝিনাইদহের মাটিতে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়, সেই যাত্রার অন্যতম একজন তিনি। আর বিএনপির বিভিন্ন আমলে অনেকেই গা ঢাকা দিলে রাজনীতির ময়দানে কেবল সততা আর বিশ্বাস দিয়েই তিনি ছিলেন উচ্চকিত এক কণ্ঠস্বর। নিজ ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধিও হন। বর্ষীয়ান এই মানুষটি নিজেই তাই মেলাতে পারছেন না সৎ রাজনীতির প্রতিদানে এ কী উপহার পেলেন তিনি? কারণ যারা তাকে গরুর মতো করে পিটিয়েছে তারা অন্য কেউ না, তার নিজ দলের সূর্যসন্তানেরা, আবার বয়সে সন্তানতুল্যও। স্বভাবতই তাঁর বেদনার ক্ষতটা ভীষণ তীব্র এবং গভীর।
একাত্তরের রণাঙ্গনের মানুষ মুক্তার মৃধা ১৯ শে অক্টোবর নিষ্ঠুর হামলার শিকার হন। সিসিটিভিতে ধরা পরে বিষয়টি। পরেরদিনই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই ন্যাক্কার হামলার চিত্র। ঐদিন সন্ধ্যায় চিরচেনা প্রিয় শৈলকূপা বাজারের একটি ওষুধের দোকানে তিনি বসেছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ উপজেলা যুবলীগের নেতা ভাইস চেয়ারম্যান শামীমের নেতৃত্বে কয়েকজন এসে তাঁকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় অসহায়ের মতো তিনি কেবলই মার খাচ্ছেন। সিনেমা স্টাইলে ঘেরাও করে লাঠি, রড আর হাতুড়ির আঘাত চলে তার উপর। এহেন হামলায় কেউ ঠেকাতে না এলেও পাশে থেকে ছুটে আসেন তার ব্যাংকার পুত্র। পিতাকে বাঁচাতে ছেলে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অতঃপর শামীমের নেতৃত্বে ছেলে মোরশেদের উপরও হামলা চলে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী হামলার কারণ ছিল মুক্তার মৃধার একটি ঠিকাদারী কাজ পাওয়া। অনলাইনে সর্বনিম্ন দরপত্র দিয়ে এলজিইডির একটি কাজ পেয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি শৈলকুপা উপজেলার রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে ছয় কোটি টাকার চারটি দরপত্র আহ্বান করে এলজিইডি। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার মৃধা ১৭ অক্টোবর অনলাইনে দরপত্র জমা দেন। যাচাইবাছাই শেষে ১৮ অক্টোবর বিভিন্ন শর্ত পূরণ করায় ও সর্বনিম্ন দরপত্র হওয়ায় তিনি ছয় কোটি টাকার কাজ পেয়ে যান। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ই-টেন্ডারে অংশ নেয়ায় নিজ দলের এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই এবং শৈলকূপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোনা সিকদারের ক্যাডাররা তাকে নির্মমভাবে মারধর করে ঠেলে দেয় মৃত্যুর পথে।
মুক্তার মৃধাকে ঢাকাতে হাসপাতালে ভর্তি করার পর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ অনেকেই দেখতে গিয়েছিলেন। আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকও দেখতে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সহ-সভাপতি শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, বিচারপতি, সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শহীদ সন্তান নুজহাত চৌধুরীসহ আরও অনেকেই গিয়েছিলেন। অনেকেই সমবেদনা জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষ অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ততই সেই প্রতিবাদের ধার কমে আসছে।
১৯ অক্টোবের আগেও মুক্তার মৃধাকে আরেকদফা অপমান করা হয়। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মুক্তার মৃধা শৈলকূপার আবাইপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন করতে পারেননি স্থানীয় এমপি আর তাঁর সহযোগীদের কারণে। স্থানীয় এমপির নির্দেশে আওয়ামী লীগের একটি অংশ সমর্থন করে মুক্তার মৃধার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। অর্থকড়ির প্রভাব আর প্রশাসনের নিরপেক্ষতাহীনতার কারণে শেষমেশ চোখের জলে নির্বাচনের আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষনা দিতে হয় মুক্তার মৃধাকে। এরকম আরও অনেক ঘটনাই আছে।
মুক্তার মৃধা বাড়িতে ফিরে গেলেও একটি প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় এখনও মেলেনি যে-একজন মুক্তিযোদ্ধার উপর হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছেন, যারা মদদদাতা তারা কেন জবাবদিহিতার বাইরে থেকে গেলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী স্থানীয় এমপিই মূল মদদদাতা এবং যারা সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছিল তারা সবাইই তার অনুসারী বলে পরিচিত। স্থানীয় এই এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতিদিনই বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর অপকর্ম নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে তিনি পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন।
এদিকে এই হামলার পর সবচেয়ে বেশি নিরব থাকতে দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদেরই। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র-কোনো পর্যায়েই সেভাবে প্রতিবাদ হতে দেখা যায়নি। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব সংগঠন রয়েছে তারাও কোনো ধরনের প্রতিবাদ করেছে বলে চোখে পড়েনি। ফলে একটা বিষয় যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের দলীয় পরিচয়ে কেউ যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধার উপর হামলা করে, অপমান করে তার কোনো বিচার হবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা মানে সব মুক্তিযোদ্ধাকেই অপমান করা। কিন্তু এত বড় অপমানের পরও মুক্তিযোদ্ধারা যেনো বসে থাকলেন। কেউ কোনো কথা বললেন না। প্রতিবাদ করলেন না। সহমর্মিতাও জানালেন না।
মুক্তার মৃধার উপর যারা হামলা করেছে এবং যারা নেপথ্যে মদদদাতা তাদের অবশ্যই সাংগঠনিক আইনের আওতায় বিচার হওয়া জরুরি। কাউকেই সামান্যতম রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। ভিডিও ফুটেছে যাদের দেখা গেছে, হামলাকারী যারা চিহ্নিত হয়েছে- তাদের প্রত্যেককে দল থেকে (কয়েকজনকে বহিস্কার করা হয়ছে) বহিস্কার করা উচিত। শৈলকূপার উন্মাদ, উন্মাতাল কতিপয় যুবলীগ কর্মী একজন মুক্তিযোদ্ধার গায়ে হাত তুলে প্রমাণ করেছে তারা কতোটা বেপরোয়া এবং রাজনৈতিক জ্ঞান বিবর্জিত। এ সবকিছুতেই প্রমাণ হচ্ছে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় যেনো এক নিকৃষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে আমরা কেবলই ডুবে যাচ্ছি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)