অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

যদিও সর্বশেষ খবরে অক্সফোর্ড ও ব্রিটিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রজেনিকার তৈরি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় কম বলা হচ্ছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বলা হয়, তাদের তৈরি ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে গড়ে ৭০% কার্যকরী।

বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনার ভিত্তিতে তিন ধরনের কার্যকারিতা মাত্রা উল্লেখ করা হয়েছে। এর গড় কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ, সবচেয়ে কম কার্যকারিতার মাত্রা ৬২ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ মাত্রা ৯০ শতাংশ। তার বিপরীতে মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বলা হচ্ছে ৯৪.৫ ও ৯৫ শতাংশ।

এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর  বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অক্সফোর্ড উপস্থাপিত ডাটাগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সে প্রশ্নটি এর নিরাপত্তা নিয়ে নয়, বরং এ ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকর তা নিয়ে।

এরপরও দাবি করা হচ্ছে, এটিই অন্য ভ্যাকসিনের তুলনায় বিশ্বে সর্বাধিক উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন। সামনে এই ভ্যাকসিনের বিস্তারিত ফলাফল আসলে এই বিষয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলছেন ভ্যাকসিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।

এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য সরকার শুক্রবার ভ্যাকসিনের অনুমোদনের প্রক্রিয়ার শুরু করেছে। দেশটির ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রক্রিয়া শুরুর জন্য বলা হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনকে কেন অন্য ভ্যাকসিনের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে?

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির নাম সিএইচএডিওএক্সওয়ান এনকোভ-১৯ (ChAdOx1 nCoV-19)। এই ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সিএইচএডিওএক্সওয়ান’ ভাইরাস, যা মূলত সাধারণ সর্দিকাশির দুর্বল ভাইরাস (অ্যাডেনোভাইরাস) হিসেবে পরিচিত। আর এই ভ্যাকসিন তৈরিতে অক্সফোর্ড গবেষক দলে নেতৃত্বে দিচ্ছেন একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিজ্ঞানী সারাহ গিলবার্ট। যার ইতিপূর্বে ইবোলা ভাইরাসের সফল ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠান হিসেবে অক্সফোর্ডের সুবিধা হলো, এর অভ্যন্তরে ভ্যাকসিন উৎপাদনের সুযোগ বিস্তৃত। ফলস্বরূপ একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হিউমান ট্রায়ালের জন্য যতটুকু ভ্যাকসিন শটের প্রয়োজন ছিল, তা বেশ দ্রুত প্রস্তুত হয়ে যায়। এভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ শেষ করে তৃতীয় ধাপও শেষের প্রায় শেষ। এখন রয়েছে চূড়ান্ত অনুমোদনের পথে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভ্যাকসিন সংরক্ষণে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এগিয়ে। এই ভ্যাকসিন কমপক্ষে ৬ মাসের জন্য ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় (৩৬-৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এ সংরক্ষণ করা যাবে। অন্যদিকে মডার্নার জন্য প্রয়োজন হবে তা ২০ ডিগ্রি এবং ৩০ দিনের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে। আর ফাইজার ও বায়োএনটেক এর ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করে রাখতে প্রয়োজন হবে ৭৫ ডিগ্রি সেলয়িাস তাপমাত্রা এবং ৫ দিনের মধ্যে একবার ব্যবহার করতে হবে উচ্চ তাপমাত্রা।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে, ২০২১ সালে রোলিং ভিত্তিতে ৩ বিলিয়ন ডোজ পর্যন্ত উত্পাদন করতে সক্ষম হবে। আর বায়োএনটেক বলছে, ২০২০ সালে ৫০ মিলিয়ন ও ২০২১ সালে ১.৩ বিলিয়ন ডোজ তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে মডার্না বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করতে সক্ষম করা যেতে পারে এবং ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করতে পারবে।

এছাড়াও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন তুলনামূলক অনেক সস্তা। ফাইজার যেখানে প্রতি ডোজ ২০ ডলার ও মডার্না ৩২-৩৭ ডলার ডোজ, সেখানে অক্সফোর্ডের প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের মূল্য পড়বে ৩ থেকে ৪ ডলার।

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের সংক্রামক রোগ মহামারির প্রধান আজরা ঘানি সিএনএনকে বলেন, ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিনের তুলনায় অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ ও সরবরাহ পদ্ধতি সহজ ও কম ব্যয়বহুল।

তিনি বলেন, “কোল্ড চেইন” রেফ্রিজারেশন হচ্ছে স্থানীয় স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করার বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত গ্রহণযোগ্য সংরক্ষণাগার। অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনিকার ভ্যাকসিনটি এই  নিয়মগুলোতেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

ভ্যাকসিনগুলো নানা প্রকার প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। জনসন ও জনসনের ভ্যাকসিন, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি’র মতো অ্যাস্ট্রাজেনিকার ভ্যাকসিনও একই প্রযুক্তিতে তৈরি। এটা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু মডার্না ও ফাইজার সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। তা মানবদেহের আরএনএ নামক জিনগত উপাদানের টুকরা ব্যবহার করে তৈরি।

যুক্তরাজ্যের ফার্মাসিউটিক্যাল মেডিসিন অনুষদের শিক্ষা ও স্ট্যান্ডার্ড কমিটির চেয়ারম্যান পেনি ওয়ার্ড বলেন, এটি তুলনামূলকভাবে নতুন প্রযুক্তি এবং সময়ের সাথে সাথে আরএনএ এর স্থিতিশীলতা সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে।

তিনি বলছেন, মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী সরবরাহে যে পরিমাণ দুষ্কর হবে ঠিক তার বিপরীতে সহজেই প্রেরণ করা সম্ভব হবে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন কেবল তখনই মূল্যবান হবে যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিতরণের সময় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মাত্রা বজায় থাকে।

মডার্না ও ফাইজার যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভাক্স জোটে এখনো অবধি চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়নি, সে দিক থেকে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ও অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিন এগিয়ে রয়েছে। তাই এই ভ্যাকসিনটি বিশ্বের জন্য সত্যিই সুসংবাদ।

অক্সফোর্ডের তৈরি এই ভ্যাকসিন স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে সরবরাহের জন্য কোভাক্সের সঙ্গে ৩০০ মিলিয়ন ডোজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অলাভজনক ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উন্নয়নশীর দেশগুলোতে এর পরিবহন ও বিতরণ সহজ হবে, যেহেতু দীর্ঘদিন এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হবে।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনকরোনাভাইরাসফাইজারমডার্না